ক্রেতাদের সুনজরে বাংলাদেশ

সস্তায় পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশের সুনাম বেশ পুরোনো। এই সুবিধার জন্যই আগামী দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বা ব্যবসা পাবেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। যদিও করোনা–পরবর্তীকালে পোশাকের ভোক্তাদের চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া বৈচিত্র্যময় পোশাক তৈরিতেও বাংলাদেশ অবশ্য চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে বেশ পিছিয়ে।

‘২০২১ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক এক জরিপে এমন তথ্যই ওঠে এসেছে। মার্কিন সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসএফআইএ) পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ৩১টি ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পোশাক ক্রয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাহীরা অংশ নেন। গত এপ্রিল-জুন সময়ে পরিচালিত এই জরিপের ফল গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়।

আগামী দুই বছরে কোন দেশ বা অঞ্চল থেকে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক কেনা বাড়াবে, সে বিষয়ে জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা ধারণা দিয়েছেন। তাঁদের ৫২ শতাংশ জানান, তাঁরা ভারত থেকে পোশাক কেনার পরিমাণ বাড়াবেন। ৭ শতাংশ বলেছেন, অবশ্যই বাড়বে। বাংলাদেশের বেলায় ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, তাঁরা পোশাক কেনা বাড়াবেন। আর ১১ শতাংশ বলেছেন, অবশ্যই বাড়াবেন। এ ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো হচ্ছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক ও চীন।

ব্যবসা বৃদ্ধির প্রশ্নে ক্রেতাদের দ্বিতীয় পছন্দ হচ্ছে বাংলাদেশ। এর মূল কারণ হচ্ছে সস্তা দামের সুবিধা। পোশাকের দাম কতটা সস্তা, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর প্রতি বর্গমিটার বাংলাদেশি পোশাকের আমদানি মূল্য ছিল ২ ডলার ৮০ সেন্ট। চলতি বছরে (জানুয়ারি-মে) তা কমে আড়াই ডলার হয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় দাম ২ ডলার ৬০ সেন্টের চেয়ে কম। প্রতি বর্গমিটার পোশাকের আমদানি মূল্য ভারতে সাড়ে ৩ ডলার, ভিয়েতনামে ৩ ডলার, কম্বোডিয়ায় আড়াই ডলার, চীনে ১ দশমিক ৭ ডলার।
চীনের দাম কম হলেও অন্য সমস্যায় দেশটি ছাড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে শুল্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়ে গেছে। ৭৪ শতাংশ বলেছেন, বাণিজ্যযুদ্ধ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা দুর্বল করে দিয়েছে। কারণ, চীন থেকে পোশাক আমদানিতে গত বছর গড়ে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়েছে, যা কিনা ২০১৭ সালের চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ বেশি।

চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে এশিয়ার শীর্ষ চার দেশ হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও বাংলাদেশ। ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, আগামী দুই বছরে ২০২০ সালের তুলনায় চীন থেকে ৭০ শতাংশ পোশাক কেনা কমিয়ে দিতে চান। ভিয়েতনামের পোশাকের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

সস্তায় পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশের জুড়ি না থাকলেও কয়েকটি সমস্যার কথাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। করোনা–পরবর্তী সময়ে পণ্যবৈচিত্র্য না থাকায় বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের ভোগাবে। কারণ, মহামারিকালে চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। ভোক্তারা আগের চেয়ে বেশি সোয়েটার, স্মক ড্রেস, সোয়েটপ্যান্টের মতো পোশাক বেশি পছন্দ করছেন। আর পোশাকগুলো উৎপাদনে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম বেশি পারদর্শী। আবার কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তারা মনে করে, বাংলাদেশের কারখানায় ঝুঁকি রয়েছে। যদিও রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশের বেশি বলেছেন, আগামী দুই বছরে তাঁরা পোশাক ক্রয়ের এই উৎস বদলাবেন না। তবে সরবরাহকারী কারখানার সংখ্যা বা ভেন্ডর কমিয়ে আনবেন। সেটি হলে পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে আগের চেয়ে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে। বড়দের তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো বেশি বিপদে পড়তে পারে

বিজিএমইএর পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরছে। বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় আছে, তারা ইতিমধ্যে ক্রয়াদেশ বাড়াচ্ছে। নতুন ক্রেতারাও আসতে শুরু করেছে। এটিও সত্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাক উৎপাদনে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। তবে আমরা তুলনামূলক সস্তা পোশাকগুলো ব্যাপকভাবে রপ্তানি করতে পারব।’
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের শীর্ষ বাজার। গত বছর দেশটিতে ৫২২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) ২৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।