ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে বাধ্য হয়ে পেশা বদল করেছেন

করোনার কারণে সারা দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মতো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অনেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও কেউ কেউ এরই মধ্যে পেশা বদলে ফেলেছেন। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. শরিফ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজিউর রহমান

মো. শরিফ হোসেন

প্রশ্ন :

করোনায় পঞ্চগড়ের ব্যবসা-বাণিজ্যে কেমন প্রভাব পড়েছে?

মো. শরিফ হোসেন: করোনার কারণে মার্চে লকডাউন ঘোষণার ফলে পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কৃষকেরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষিনির্ভর এ এলাকার কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জেলার বেশ কিছু কৃষক, খামারি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লোকসানের কারণে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে বাধ্য হয়ে এরই মধ্যে পেশা বদল করে ফেলেছেন। সব খাতের ব্যবসায়ীরা কমবেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে।

প্রশ্ন :

করোনার প্রথম ধাক্কা কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হয়ে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও দ্বিতীয় ঢেউ আসার কথা বলা হচ্ছে। সেটি হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার নতুন করে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? ধাক্কা মোকাবিলায় আপনাদের প্রস্তুতি কেমন?

শরিফ হোসেন: করোনার প্রথম ধাক্কা ও লকডাউন আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। নতুন করে করোনার ধাক্কা এলে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবার আমাদের ওপর আঘাত আনুক, এটা আমরা কেউ চাই না। কারণ, নতুন করে আবার ক্ষতির মুখে পড়লে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। প্রথম ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকেই
পুঁজি হারিয়েছেন। অনেক দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে তাই আবার সংকটে পড়লে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বড় একটি অংশ ঝড়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কেউ যদি আমাদের কাছে কোনো সহায়তা চান, সেটি দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত।

প্রশ্ন :

করোনার কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?

শরিফ হোসেন: বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে মূলত ভারত ও ভুটান থেকে পাথর আমদানি হয়। করোনার সময় লকডাউনের কারণে এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বন্দরনির্ভর শ্রমিকেরা একেবারেই কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন।

প্রশ্ন :

ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পোষাতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ীরা তা কি পেয়েছেন?

শরিফ হোসেন: করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, পঞ্চগড়ের কিছু ব্যবসায়ী তার সুফল পেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বিলম্ব হচ্ছে। প্রণোদনার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আমরা চেম্বারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি।

প্রশ্ন :

পঞ্চগড় চায়ের জন্য বিখ্যাত। আমরা জানি জেলায় ১৮টি চা কারখানা গড়ে উঠেছে। এখন জেলায় চায়ের তৃতীয় নিলাম বাজার গড়ে তোলার দাবি উঠেছে। এ দাবির সঙ্গে আপনারা কি একমত?

শরিফ হোসেন: চেম্বারের পক্ষ থেকে আমরাও চাই পঞ্চগড়ে চায়ের একটি নিলাম বাজার স্থাপন করা হোক। এতে চা–চাষি থেকে শুরু করে চা কারখানা মালিকেরাও উপকৃত হবেন, তা ছাড়া সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিলাম বাজারের বাইরে চা বিক্রির সুযোগও কমে যাবে। সব মিলিয়ে পঞ্চগড়ে একটি চায়ের নিলাম বাজার গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

প্রশ্ন :

পঞ্চগড়ের একমাত্র সরকারি চিনিকলটির বর্তমান অবস্থা কী?

শরিফ হোসেন: পঞ্চগড়ের চিনিকলটি জেলার ঐতিহ্য। এ এলাকার একমাত্র ভারী শিল্পকারখানা বলতে ওই চিনিকলটিই আছে। এলাকার স্বার্থে এটিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তবে লোকসানের চক্কর থেকে এটিকে বের করে আনাও সময়ের দাবি। এ জন্য কারখানাটির আধুনিকায়ন করতে হবে। আখ চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শ্রমিক দিয়ে এই কারখানাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রশ্ন :

কৃষিনির্ভর এ জেলায় কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু বিপণনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর প্রচুর কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে এ সমস্যার সমাধানে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?

শরিফ হোসেন: পঞ্চগড়ে উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। এর মধ্যে টমেটো অন্যতম। কিন্তু হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাত কারখানা না থাকায় প্রতিবছর টমেটো নষ্ট হয়। তাই সরকার এ জেলার কৃষিপণ্য সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একটি কারখানা করলে তাতে কৃষকেরা উপকৃত হবেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারা এ ধরনের কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসতে পারেন। কেউ উদ্যোগ নিলে আমরাচেম্বারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন :

পঞ্চগড়ের বিসিক শিল্পনগরীটি দীর্ঘদিনেও পূর্ণতা পায়নি। সেটি কেন?

শরিফ হোসেন: গ্যাস, বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি পঞ্চগড়ে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। এ কারণে উদ্যোক্তারা এখানে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগিয়ে আসেননি। আবার পণ্য উৎপাদনের পর সংরক্ষণ ও বাজারজাতের নানা সমস্যা তো আছেই। এসব কারণেই মূলত বিনিয়োগ কম হয়েছে। সরকার বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে চলতি বছর থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার কমিয়েছে। আশা করছি, উদ্যোক্তারা এখন এগিয়ে আসবেন। করোনার ধাক্কা না এলে এত দিনে হয়তো নতুন করে অনেকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু করোনা তা কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। তবে আশা করছি খুব দ্রুতই পঞ্চগড়ের বিসিক শিল্পনগরীটি পূর্ণতা পাবে।

প্রশ্ন :

ব্যবসার ক্ষতি পোষাতে ও সহজ করতে সরকারের কাছে আপনাদের চাওয়া কী?

শরিফ হোসেন: একজন ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে আমার প্রথম চাওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি সহজ করা দরকার। এ ছাড়া আয়কর অধ্যাদেশের ৮২ (সি)–এর ৪ উপধারার সংশোধনীটা বাতিল করা দরকার। কারণ, এই ধারা সংশোধনের কারণে তিন কোটি টাকা প্রাপ্তিতে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। ধারাটি সংশোধন করা না হলে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।