খরচ বেশি ডায়াবেটিস চিকিৎসায়, বেশি ভোগেন উচ্চ রক্তচাপে

ষাটোর্ধ্বদের নিয়ে বিআইডিএসের জরিপ

  • ৮২% নাগরিক হতাশায় ভুগছেন

  • ৯৩% অসুস্থতায় ভুগছেন

  • ডায়াবেটিসের পেছনে গড়ে খরচ ১৪,১১৮ টাকা

  • শুধু টাঙ্গাইল জেলার ওপর জরিপটি পরিচালিত

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানা ধরনের অসুখ দানা বাঁধে। তখন আয়ের বড় একটি অংশই খরচ হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। চিকিৎসায় খরচ বেড়ে গেলে চাপ তৈরি হয় পরিবারের ওপর।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, ষাটোর্ধ্ব ৮২ শতাংশ নাগরিকই হতাশায় ভোগেন। হতাশা বলতে বয়স্ক ব্যক্তিরা তাঁদের মানসিক হতাশার কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, চলতে-ফিরতে সমস্যা; আবার কেউ বলেছেন জীবন নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। যাঁদের বয়স ষাটের ওপরে, তাঁদের ৯৩ শতাংশই অসুস্থতায় ভোগার কথা জানিয়েছেন।

বিআইডিএস ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু টাঙ্গাইল জেলার ওপর জরিপটি পরিচালনা করে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে জেলার ৫৮৫টি খানা বাছাই করা হয়, যেসব খানায় অন্তত একজন ষাটোর্ধ্ব সদস্য রয়েছেন। একজনের বয়স ৬০ পেরোলে তাঁদের জীবনাচরণে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তাঁরা কী ধরনের অসুখে ভোগেন, তাঁদের চিকিৎসার পেছনে পরিবারের কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়-এসব বিষয় জানার জন্যই বিআইডিএস একটি জেলা বাছাই করে জরিপটি পরিচালনা করে।

জরিপ পরিচালনার সময় থেকে আগের ছয় মাসে একজন রোগীর সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জরিপটি করা হয়েছে। জরিপে দৈবচয়নের ভিত্তিতে যে ৫৮৫ খানা বাছাই করা হয়েছে, সেখানে ৪৯ শতাংশ খানা বাছাই করা হয়েছে শহর থেকে। বাকি ৫১ শতাংশ খানা গ্রাম থেকে।

জরিপটি করার ক্ষেত্রে আমরা শুধু একটি জেলা টাঙ্গাইলকে বেছে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, যাঁদের বয়স ষাটের ওপরে, তাঁদের লাইফস্টাইল কেমন। তাঁরা কেমন আছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কী। তাঁদের চিকিৎসার পেছনে পরিবারের কত টাকা খরচ হয়। ওই জেলায় চিকিৎসাসেবার অবস্থাও বা কেমন।
আবদুর রাজ্জাক সরকার, জরিপ পরিচালনার সমন্বয়ক

জরিপে উঠে এসেছে, ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগেন উচ্চ রক্তচাপে। জরিপে অংশ নেওয়া ১৬ শতাংশ ব্যক্তি বলেছেন, তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দ্বিতীয় অবস্থান আছে গ্যাস্ট্রিক বা আলসার। ১৪.৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা গ্যাস্ট্রিক বা আলসারে ভুগছেন। ১৩.৬ শতাংশ শরীর ব্যথার কথা বলেছেন। ডায়াবেটিসের কথা বলেছেন ৮ শতাংশ ব্যক্তি। হৃদযন্ত্রের সমস্যার কথা বলেছেন ৭.৬ শতাংশ ব্যক্তি। এরপর আছে দুর্বলতা ৭ শতাংশ এবং হাঁপানির কথা বলেছেন ৫ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৪ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগছেন। দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা বলতে বোঝানো হচ্ছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার ও গ্যাস্ট্রিক।

জানতে চাইলে জরিপ পরিচালনার সমন্বয়ক বিআইডিএসের রিসার্চ ফেলো ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপটি করার ক্ষেত্রে আমরা শুধু একটি জেলা টাঙ্গাইলকে বেছে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, যাঁদের বয়স ষাটের ওপরে, তাঁদের লাইফস্টাইল কেমন। তাঁরা কেমন আছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কী। তাঁদের চিকিৎসার পেছনে পরিবারের কত টাকা খরচ হয়। ওই জেলায় চিকিৎসাসেবার অবস্থাও বা কেমন।’ আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, একটি জেলার মাধ্যমে সারা দেশের অবস্থার হয়তো প্রতিফলন হবে না, কিন্তু কিছুটা ধারণা মিলবে।

জরিপে অংশ নেওয়া অনেক রোগী বলেছেন, ওষুধ বিক্রেতা তাঁদের রক্তচাপ পরীক্ষা করেছেন। রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে সরাসরি ওষুধ দিয়েছেন।

জরিপে দেখা গেছে, কোনো পরিবারের একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাঁকে চিকিৎসা করাতে গড়ে ৭ হাজার ৭১৪ টাকা খরচ হয়। এই খরচ এক মাসে হয়নি। জরিপ পরিচালনার আগের ছয় মাসের হিসাব সংযোজন করা হয়েছে। ষাটোর্ধ্ব একজনের পেছনে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করাতে। জরিপ পরিচালনার আগের ছয় মাসে একজন ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে একটি পরিবারের খরচ হয়েছে ১৪ হাজার ১১৮ টাকা। আর উচ্চ রক্তচাপের কারণে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ১৮ টাকা।

জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ বয়স্ক মানুষ বলেছেন, তাঁরা চিকিৎসা সেবার জন্য নিকটস্থ ফার্মেসিতে গেছেন। ৩৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা চিকিৎসার জন্য জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালে গেছেন। সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে কেন নিকটস্থ ফার্মেসিতে যাওয়ার প্রবণতা বেশি, এ সম্পর্কে জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বক্তব্য হলো, সরকারি সেবা নিয়ে তাঁদের অসন্তুষ্টি আছে।

তা ছাড়া ফার্মেসিগুলো বাসাবাড়ির কাছেই অবস্থিত। এর ফলে তাঁদের টাকা ও সময় দুটোই বেঁচে যাচ্ছে। এমনকি রোগী কোনো ধরনের যাচাইবাছাই ছাড়াই ফার্মেসি থেকে যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, সেগুলো কিনছেন। আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, একজন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এভাবে ওষুধ নেওয়া উচিত নয়।

একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেশি। এখানে ৭৪ শতাংশ খরচ হয় স্বাস্থ্যসেবার পেছনে।

জরিপে অংশ নেওয়া অনেক রোগী বলেছেন, ওষুধ বিক্রেতা তাঁদের রক্তচাপ পরীক্ষা করেছেন। রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে সরাসরি ওষুধ দিয়েছেন। এ ছাড়া ইনট্রামাসকুলার ইনজেকশনও (আইএম) দেওয়া হয়েছে। তাই সারা দেশে যেসব ফার্মেসি বা ঔষধালয় গড়ে উঠেছে, সেখানে সরকারের নিয়মিত তদারকি ও সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জরিপে।

জরিপে দেখা গেছে, একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেশি। এখানে ৭৪ শতাংশ খরচ হয় স্বাস্থ্যসেবার পেছনে। জরিপে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে বয়স্ক লোকজনের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা উচিত, যাতে করে তাঁরা বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা পান।