গোপনে দর বলে দেওয়া হয়

কেনাকাটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি কেনাকাটার দুর্বলতা, দুর্নীতি, অনিয়মের বিষয়ে কথা বলেছেন সরকারি সংস্থা সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন। অনুলিখন করেছেন জাহাঙ্গীর শাহ

ফারুক হোসেন

উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটা প্রক্রিয়া শুরুর আগেই একটি প্রাক্কলিত দর ঠিক করে থাকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করার আগেই যে পণ্য বা সেবা কেনা হবে, এর আনুমানিক দাম ধরা হয়। সেখানে ওই পণ্য বা সেবার সর্বশেষ বাজারদরের পাশাপাশি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের মুনাফাসহ অন্যান্য খরচও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া দর কোনোভাবেই প্রাক্কলিত দরের বেশি হতে পারে না।

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে পণ্যের প্রাক্কলিত দর গোপন রাখতে হবে, এটাই সরকারি কেনাকাটার নিয়ম। প্রাক্কলিত দরের সঙ্গে ঠিকাদারের দরের সামঞ্জস্য থাকলে, তা গ্রহণ করা হয়। যদি দরপত্রে অংশ নেওয়া কোনো সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পণ্যের দর বেশি দেয়, তাহলে ধরা পড়বেই।

বাস্তবতা হলো বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের কেনাকাটায় পণ্য বা সেবার প্রাক্কলিত দর আগে থেকে ঠিক করে না। এ কারণে গণপূর্ত বিভাগে বালিশকাণ্ড ঘটেছে। ২০০-৩০০ টাকার বালিশ ২০ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। এর কারণ, কেনাকাটার আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক দর প্রাক্কলন (অফিশিয়াল কস্ট এস্টিমেট) করেনি কিংবা ঠিকাদার দরপত্রে যে দাম দিয়েছে, সেই দামের সঙ্গে মিলিয়ে পরে দর প্রাক্কলনের কাগজপত্র ঠিক করা হয়েছে। আমি যখন সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক ছিলাম, তখন বহুবার বলেছি, কেনাকাটার আগেই যেন দর প্রাক্কলন করা হয়।

এ ছাড়া প্রতিটি দরপত্র মূল্যায়ন করার জন্য কমিটি থাকে। ওই কমিটির সব সদস্যই যদি এই অসাধু প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে কীভাবে কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আসবে? কেনাকাটায় স্বচ্ছতা রাখতে দরপত্র প্রক্রিয়া সামাল দেওয়ার মতো লোক নেই। সরকারি কেনাকাটার প্রক্রিয়াটি কাগজে–কলমে ঠিকই আছে। কিন্তু অনেক সময় তা মানা হয় না।

সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে ই-জিপি বা ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে দরপত্র প্রক্রিয়ায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনতে হবে। সনাতনী কাগুজে প্রক্রিয়ায় দরপত্র হলে স্বচ্ছতা আনা কঠিন। দুর্নীতি-অনিয়ম হবে। যেমন বহুল আলোচিত জি কে শামীমের সব দরপত্র সনাতনী পদ্ধতিতে হয়েছে। আমি সিপিটিইউয়ের দায়িত্ব পালনকালে গণপূর্ত বিভাগকে ই-জিপিতে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তখন তারা আসেনি। এখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে সীমিত পরিসরে ই-জিপিতে আসতে শুরু করেছে।

সনাতনী পদ্ধতির দরপত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা ঠিকাদারকে অনেক সময় গোপনে দর বলে দেওয়া হয়। আবার এমনভাবে দরপত্রের বৈশিষ্ট্য ঠিক করা হয়, যাতে নির্দিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। অবশ্য ই-জিপিতে এটির সুযোগ কম। তবে আগে জেলা বা খাতভিত্তিক ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট ছিল। এখন তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিকাদার সমিতির লোকজনই বলে দেন, অমুক দরপত্রে কারা অংশ নেবেন, কারা নেবেন না।

সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথোরিটি) গঠন করা উচিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো পণ্য বা সেবার দর প্রাক্কলন করছে কি না, দরপত্রে অংশ নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, এসব বিষয় দেখবে ওই কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালে সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ গঠনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে আইন প্রণয়ন করে তা গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু সচিব কমিটি এখনো ওই আইনের খসড়া অনুমোদন করেনি।