চার্লসের রান্না এখন সুগন্ধ ছড়ায় না, খাবারের দুশ্চিন্তায় কাটে বেলা

চার্লস এ গোমেজ। রাজধানীর বনানীতে রোজ গার্ডেনসহ বিভিন্ন হোটেল, গেস্টহাউসে কুক-শেফ বা বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছেন। ‘কাল থেকে আপনাকে আর আসতে হবে না’, মালিকের এই বক্তব্যের পর চলতি মাসের প্রথম দিকে তাঁর বাবুর্চির চাকরি চলে গেছে।

চলতি মাসের বেতনও দেননি মালিক। নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে আর সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছেলে, স্ত্রী নিয়ে এখন দিন চলছে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে। চার্লস ভাবতেই পারেননি, দুটো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে হবে। অথচ চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনিই মিরপুরের সেনপাড়া থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকেল চালিয়ে গেছেন কিছু সহায়তা পাওয়ার আশায়। মুঠোফোনে বললেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমি নিরুপায়। পরিবার নিয়ে বাঁচতে চাই। কিন্তু আমার চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।’

গত বুধবার বিকেলে কথা হয় চার্লস এ গোমেজের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সারা দিন বাইরে একটি কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে। বাসায় আলু আর ডাল ছাড়া কিছু নেই। এক ডাল আর আলু কত আর রান্না করা যায়? তাই স্ত্রী রান্না করেননি। ছেলে–মেয়েরা না খেয়ে বসে আছে। তাই বাধ্য হয়েই চার্লস রান্না করতে বসেছেন। একসময় চার্লসের হাতের বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন মজাদার খাবারের প্রশংসা করতেন হোটেল বা রেস্টুরেন্টে খেতে আসা লোকজন। এখন আর চার্লসের রান্না কোনো সুগন্ধ ছড়ায় না।

চার্লস বলেন, সর্বশেষ মোহাম্মদপুরে যেখানে চাকরি করতেন, সেখানে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। করোনা শুরু হলে ১০ হাজার টাকা করে পেতেন। তারপর হুট করে চাকরিটাই চলে গেল। যে বেতন পেতেন, তা দিয়ে বাসাভাড়া, ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ, খাওয়ার খরচ চলে যেত। সঞ্চয় বলে কিছু নেই। আর চাকরি চলে যাওয়ার পর তো অবস্থা আরও শোচনীয়। আগে থেকেই বাড়িভাড়া বাকি ছিল, চলতি মাসের ভাড়াও বাকি রাখতে হবে। কপাল ভালো যে বাড়িওয়ালা এখন পর্যন্ত বাড়ি ছাড়তে বলেননি। কিন্তু ভাড়া দিতে না পারলে তিনিই–বা কত দিন বাসায় থাকতে দেবেন।

চার্লস এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করায় ১৮ বছর ধরে দুই পরিবারের স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ যোগাযোগ করেন না। চাকরি চলে যাওয়ার পর চার্চে গিয়েছিলেন সহায়তা পাওয়ার আশায়। করোনায় সেখানে ঢোকা যায় না, সারা দিন বসে থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। টেলিভিশনে দেখেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে তানভীর হাসান ও অন্যরা করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্যসহায়তাও দিচ্ছেন। তাই তিনিও অনেকটা গোপনেই সেখানে গিয়েছিলেন।

আক্ষেপ করে চার্লস বললেন, ‘সহায়তা নিতে গেছি, অথচ আমি ভিক্ষুক নই। আমার পোশাকও সহায়তা নেওয়ার মতো নয়। কিন্তু আমি তো নিরুপায়। ঘরে খাবার প্রায় ছিলই না। এক বেলা খেয়ে অন্য বেলা না খেয়ে আর কত দিন থাকা যায়। টিএসসিতে গিয়ে আমি ওই ভাইকে (তানভীর হাসান) আমার অসহায়ত্বের কথা বলতে পেরেছি। পাঁচ কেজি চাল, এক লিটার তেল, দুই কেজি আলুসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছেন। বলেছেন, বেশি বিপদে পড়লে তাঁকে জানাতে।’

চার্লস বললেন, দুই দিন পর শুধু খাবার কেনার জন্যই হয়তো ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে হবে।

চার্লস বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য বের হলেও কোনো জায়গা থেকেই এখন পর্যন্ত কোনো আশ্বাস পাননি। চলমান বিধিনিষেধ শেষ হলে হোটেল-রেস্টুরেন্ট চালু হলেও মালিক নতুন লোক নিয়োগ দেবেন কি না, তা নিশ্চিত নন। কথায় কথায় আবেগাক্রান্ত হয়ে চার্লস বলেন, ‘কারও কাছে ভিক্ষা চাইতে পারব না। সহায়তা চাইতেও লজ্জা লাগে। চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে, জীবনবৃত্তান্ত বানাতেও তো খরচ। যে প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি চলে গেছে, সেই মালিকও বলেছেন, সময় হলে তিনি নিজেই আমাকে ফোন করবেন। কিন্তু সময়টা হবে কবে?’

প্রথম আলোতে চার্লসের নাম ও ছবি ছাপা হলে কোনো সমস্যা আছে কি না, জানতে চাইলে চার্লস বললেন, ‘আপত্তি নেই। আপত্তি করে লাভ নেই। আগে তো বাঁচা, তারপর তো আপত্তির প্রশ্ন।’