জ্বালানি খাতে যে কারণে বিদেশনির্ভরতা

বাংলাদেশের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী সংস্থা বাপেক্স ৩১ বছরেও নিজেকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারেনি। এ কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিদেশনির্ভরতা বেড়েছে, ফলে দুর্বল হয়েছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাপেক্সকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে এবং এর পরিচালনা পর্ষদে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা না হলে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াতে পারবে না। অন্যদিকে সরকার বলছে, বাপেক্স নিজেরাই চায় না শক্তিশালী হতে।

 জানা গেছে, গত সাত বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে আটজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে দায়িত্বে এসেছেন। তা ছাড়া এর বোর্ড সভায় সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদেরই প্রাধান্য থাকে। ফলে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারেনি বাপেক্স। গত তিন দশকে বাপেক্স বড় হতে পারেরি, চলছে ঢিমেতালে।

অথচ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্স দেড় হাজারের বেশি ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে খুব কম অর্থ ব্যয় করে। এই জরিপের ভিত্তিতে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনাসহ দক্ষিণ অঞ্চলের নতুন ধরনের ভূকাঠামোতে বিপুল গ্যাস থাকার আভাস মিলেছে। কিন্তু সেখানে যে সংখ্যক কূপ খনন করার দরকার ছিল, সেই অনুমতি বাপেক্সকে দেওয়া হয়নি। ১৯৮৯ সালে বাপেক্স গঠন করা হয়। তখন এর কাজ ছিল শুধু তেল–গ্যাস অনুসন্ধান করা। পরে একে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের এবং উন্নয়ন ও উৎপাদন কোম্পানি হিসেবে পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

২০১৩ সালের এপ্রিলে বাপেক্সের এমডি হিসেবে মোর্তজা আহমেদ ফারুক অবসরে যান। এরপর সেখানে আসেন মো. আবদুল বাকি, তিনি বিদায় নেন ২০১৪ সালে। তারপর পর্যায়ক্রমে আসেন মাহবুব সরওয়ার, মো. আতিকুজ্জামান, নওশাদুল ইসলাম, রুহুল চৌধুরী ও মীর আবদুল হান্নান। বাপেক্সের এমডি পদে এখন দায়িত্ব পেয়েছেন মো. আলী। তিনি আগামী বছরের জুলাই মাসে অবসরে যাবেন।

>

সাত বছরে আট এমডি
সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের, দুজন রাজনৈতিক বিবেচনায় এসেছেন
তাঁদের কারিগরি বা মাঠের জ্ঞান নেই।

বাপেক্সকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম মুঠোফোনে
প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যদি বাপেক্সকে গড়ে তুলতে সত্যিই আন্তরিক হয়, তবে এটির ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। বাপেক্স এখন
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেটি থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে প্রধান নির্বাহী ও এমডি পদে নিয়োগ দিতে হবে।

বাপেক্সের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাপেক্সকে চারটি রিগ কেনার পাশাপাশি একটি পরিকল্পনা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২১ সালের মধ্যে ৫৫টি অনুসন্ধান কূপ, ৩১টি উত্তোলন কূপ ও ২২টি পুরোনো কূপ সংস্কার করবে। এসব করা গেলে দৈনিক ৯০ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়বে। এ প্রকল্প অর্থের জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়। প্রতিবছর এ তহবিলে জমা হতে থাকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

অথচ বাস্তব চিত্র হচ্ছে, গত ১০ বছরে বাপেক্স মাত্র ১২টি কূপ খনন এবং চারটি কূপ সংস্কার করেছে। এর মধ্যে আবার দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে ৭টি কূপ খনন করানো হয়েছে। ফলে গোটা সময় মূলত বাপেক্স বসে ছিল দামি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং লোকবল নিয়ে।

বাপেক্স সূত্র জানায়, তাদের প্রতিটি কূপ খনন করতে খরচ হয় গড়ে ৮০ কোটি টাকা। আর বিদেশি কোম্পানি নেয় গড়ে ১৫০ কোটি টাকা। ত্রিমাত্রিক জরিপ করতে বাপেক্সের খরচ হয় প্রতি কিলোমিটারে ৯ থেকে ১৩ লাখ টাকা আর বিদেশি কোম্পানি নেয় সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা।
গ্যাসকূপ খনন না করে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। বর্তমানে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির পেছনে বছরে ব্যয় হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাপেক্স নিজেরাই চায় না তারা শক্তিশালী হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার ছিল বাপেক্সকে শক্তিশালী করা। সে কারণে সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর চারটি নতুন রিগ কিনে দিয়েছে। দেড় হাজারের বেশি ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে, বেশ কিছু নতুন গ্যাসক্ষেত্র বাপেক্স আবিষ্কার করেছে কিন্তু তারপরও বলব, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় বাপেক্স যেতে পারেনি, এটি তাদের মনোভাবের কারণে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাপেক্সকে বলা হয়েছিল পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রের একটি মূল্যায়ন করার জন্য। তারা ছয় মাসেও কাজই শুরু করেনি। তারা সরকারি অফিসের মতো ধীরগতিতে চলবে। তবে বাপেক্সে পরিবর্তন আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন রিগ কেনা হলেও বাপেক্সকে তা ব্যবহারের জন্য কূপ খননের অনুমতি দেয়নি জ্বালানি মন্ত্রণালয়। উল্টো জ্বালানি বিভাগ ভোলায় কূপ খননের কাজ গাজপ্রমকে দিয়েছে দ্বিগুণ দামে। বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে হলে সংস্থাটির আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো তাকে দিয়েই খননের কাজ
করাতে হবে। তাঁর মতে, মূলত বিদেশি কোম্পানি ও এলএনজি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাপেক্সকে শক্তিশালী করার ইচ্ছা নেই সরকারের।

পরিচালনা পর্ষদ সরকারের ইচ্ছায়, বিশেষজ্ঞ কম

বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে একজনকে বাপেক্স থেকে নেওয়া হয়েছে। তিনি বাপেক্সের এমডি। বাকি ছয়জনের মধ্যে তিনজন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের, দুজনকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও একজনকে নেওয়া হয়েছে সরকারি সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি থেকে।

পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান। তিনি বাপেক্সের চেয়ারম্যান ও একই সঙ্গে আবার বাপেক্সের এমডির নিয়োগকর্তাও। পরিচালনা পর্ষদে আরও আছেন অতিরিক্ত সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এ বি এম আবদুল ফাত্তাহ। জ্বালানি বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের পদ খালি রয়েছে, সে জন্য পরিচালনা পর্ষদের এ সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে আরও আছেন দেশের জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতিকুজ্জামান। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে রাখা হয়েছে মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন (এফসিএ) ও দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যানালাইসিসের (আইআইবিএ) সাধারণ সম্পাদক এম শোয়েব চৌধুরীকে। জিটিসিএলের এমডি ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে কারও কোনো কারিগরি ও মাঠের জ্ঞান নেই।

নাম না প্রকাশের শর্তে বাপেক্সের একজন সাবেক এমডি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মগনামা-২-এ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস নেই’—বাপেক্সের কারিগরি কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনসহ ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদের সভায় একটি প্রস্তাব তোলা হয়। কিন্তু কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে বাপেক্সের পর্ষদ অস্ট্রেলিয়ার সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে মগনামা-২ কূপ খননের সিদ্ধান্ত নেয়। কূপ খননের মাত্র আট দিনের মাথায় জানা যায়, সেখানে গ্যাস নেই। এর ফলে ২৩০ কোটি টাকা খোওয়া গেছে বাপেক্সের।

বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতিকুজ্জামান প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে সান্তোসের প্রস্তাবটি বোর্ডে তুলেছিলাম, যাতে প্রস্তাবটি পাস না হয়। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন জ্বালানি সচিব, সেখানে অন্যদের কিছু করার ছিল না।’