ডিজিটাল ইনভয়েস ফ্যাক্টরিংয়ের সুফল মিলবে অর্থনীতিতে

খোরশেদ আলম

সুজন চৌধুরী, পেশায় একজন চামড়া খাতের প্রযুক্তিবিদ বা লেদার টেকনোলজিস্ট। নিজের ছোট্ট কারখানা থেকে প্রতি মাসে দেশের স্বনামধন্য জুতা কোম্পানিতে বাকিতে জুতা ও চামড়াজাত পণ্য সরবরাহ করেন।

একইভাবে সাভারের জমিরন নেসা তাঁর কৃষি খামারে উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন সুপারশপে সরবরাহ করেন। পণ্য সরবরাহের বিনিময়ে কিছু টাকা তাৎক্ষণিকভাবে পান, বাকিটা বকেয়া থেকে যায়। আর বগুড়ার সাধন দাস তাঁর দুগ্ধ খামারের উৎপাদিত দুধ বিভিন্ন দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিতে সরবরাহ করেন। বাকিতেই দুধ বিক্রি করেন তিনি। বাকিতে বিক্রির কারণে খামার পরিচালনায় তাঁকে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ করতে হয়।

তিনজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার এ চরিত্র কাল্পনিক। চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও দেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উদ্যোক্তাদের বড় একটি অংশই এভাবেই বাকিতে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রচলিত নিয়মে ঋণ পাওয়া তাদের জন্য খুবই দুরূহ ব্যাপার। কারণ, কোনো কোনো উদ্যোক্তার ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সও থাকে না। পরিবেশ ছাড়পত্র বা অন্য কোনো রেগুলেটরি সনদ নেওয়ার সক্ষমতাও নেই অনেকের। আবার ঋণের জন্য জামানত দেওয়ার মতো সম্পদ থাকে না। আবার পণ্য সরবরাহ করে বকেয়া পাওনাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়মতো পান না। কখনো কখনো বিভিন্ন অজুহাতে পণ্যের দাম পেতে বেশ বিলম্ব হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করপোরেট ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো নগদ মূল্য পরিশোধে বেশি হারে মূল্যছাড় বা ডিসকাউন্ট করে থাকে। তাতে পণ্য সরবরাহকারী ছোট ছোট উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্যে ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮ জানুয়ারি ইনভয়েস ফ্যাক্টরিং বা রিসিভেবল ফিন্যান্সিংয়ের জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠনের নীতিমালা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এ নীতিমালার ফলে পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যে বা সেবার প্রকৃত মূল্য সময়মতো পাবে। আবার চলতি মূলধনের জন্য ইনভয়েস ফ্যাক্টরিং বা রিসিভেবল ফিন্যান্সিংয়ের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে।

প্রচলিত নিয়মে ইনভয়েস ফ্যাক্টরিং একটা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল প্রক্রিয়া। ফলে সীমিতসংখ্যক গ্রাহক হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এই সুবিধা পান। ইনভয়েস ফ্যাক্টরিংয়ের পূর্বশর্ত হলো ক্রেতা বা সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিল অ্যাসাইনমেন্টের চিঠি নিশ্চিত করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অ্যাসাইনমেন্ট পেতে পণ্য বা সেবা সরবরাহকারী এসএমই উদ্যোক্তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী অ্যাসাইনমেন্ট দিতেই চায় না। ফলে বিলের বা পাওনা টাকার বিনিময়ে ডিসকাউন্ট সুবিধা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে ইনভয়েস ফ্যাক্টরিং নীতিমালা নিঃসন্দেহে এসএমই গ্রাহকদের (সরবরাহকারী) রিসিভেবল ফিন্যান্সিংয়ের একটি সুন্দর ও সহজ সমাধান দেবে। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বেগবান হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত ক্রেতা, বিক্রেতা (পণ্য ও সেবা সরবরাহকারী) এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তির আওতায় থাকবে বিধায় ফ্যাক্টরিং ঋণের ঝুঁকি কমে যাবে। আবার নির্ধারিত সময়ে পাওনা পরিশোধের নিশ্চয়তা থাকবে, যা পণ্য বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে চলতি মূলধন পেতে বিপত্তিতে পড়তে হবে না।

ইনভয়েস ফ্যাক্টরিংয়ের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ইন্টার-অপারেবল হলে এক ব্যাংকের গ্রাহক, অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিল ডিসকাউন্ট করতে পারবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বড় সব করপোরেট কোম্পানিকে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে, তাই এই প্ল্যাটফর্ম চালু হলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সরবরাহকারীদের বিলে ডিসকাউন্ট সুবিধা দিতে পারবে। এতে নগদ ব্যবস্থাপনা বা ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সহজ হবে। এ প্রক্রিয়ায় ত্রুটিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্টের শঙ্কা থাকবে না। ছোট ছোট সরবরাহকারীরা গ্রামে বা শহরতলিতে অবস্থান করেও খুব সহজেই বিল ডিসকাউন্ট সুবিধা পাবেন। স্থানীয়ভাবে ইনভয়েস ফ্যাক্টরিংকে জনপ্রিয় করতে হলে ব্যাপক প্রচারণা এবং সেই সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সরবরাহকারীদের এই সুবিধার বিষয়কে অবহিত করতে হবে। এতে করে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট উদ্যোক্তা অনুপ্রাণিত হবে। সরবরাহব্যবস্থাও সুদৃঢ় থাকবে। তাই এই ডিজিটাল ইনভয়েস ফ্যাক্টরিং প্ল্যাটফর্মের সফলতা কামনা করি।