তরুণদের বাজেট ভাবনা

>বাজেট সবার। জাতীয় সংসদে পেশ করার পরে বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন বাজেটের বিভিন্ন দিক। পাশাপাশি বাজেট নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার তরুণদেরও মতামত আছে, ভাবনা আছে। তাঁদের অনেক প্রস্তাবও আছে। তরুণদের বাজেট ভাবনা জানতেই এই আয়োজন।
পার্থপ্রতীম চৌধুরী
পার্থপ্রতীম চৌধুরী

দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণ জরুরি
পার্থপ্রতীম চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আমি বাজেট খুব একটা বুঝি না। আমার পেশা চিকিৎসা দেওয়া, সেটিই আমি ভালোভাবে পেশাদারত্বের সঙ্গে করার চেষ্টা করি। করোনা মহামারির শুরু থেকে নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা অব্যাহত আছে। করোনাকালে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দক্ষ জনবলের বেশ ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে আমার কর্মপরিধির মধ্যে আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, সরকার ও আমাদের পরিচালকের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সেগুলো চালানোর মতো দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে আমাদের। করোনা না এলে এ ঘাটতিটুকু হয়তো আমরা সেভাবে বুঝতে পারতাম না।

করোনার সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে সরকার চিকিৎসকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। বাজেট বলি আর এমনিতেই বলি, সরকার চিকিৎসা খাতের দুর্বলতা দূর করার সব ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমি প্রত্যাশা করি। বর্তমান বাস্তবতায় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সক্রিয় করতে উদ্যোগ দরকার।

বাজেটে আমার যে প্রত্যাশা, তা হলো একজন নাগরিক হিসেবে আমার জীবনযাত্রা সহজ হবে। যাঁরা কর দেন, শুধু তাঁদের ওপর বছর বছর করের বোঝা না চাপিয়ে নতুন নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা দেখি, যেকোনো ছুতোয় আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় রাতারাতি। এই করোনার সময়েও আমরা দেখছি ১০–২০ টাকার জিনিস ১০–২০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এটি যেন না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

 এ ছাড়া করোনায় চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে কোনো চিকিৎসক যদি আক্রান্ত হন, তা হলে জরুরি ভিত্তিতে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। আর কোনো চিকিৎসক যদি সেবা দিতে গিয়ে মারা যান, সরকারের উচিত তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। পাশাপাশি যেকোনো রোগীর সেবা দেওয়া চিকিৎসকের ধর্ম। নিজের জীবনের কথা চিন্তা করে চিকিৎসকেরা সেবাদান থেকে দূরে থাকবেন, এটাও কাম্য নয়।

 আমি জানি, আমাদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। যেটুকু সম্পদ আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে বাজেটে। আমি মনে করি, বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সংকট অনেক কমে আসবে।

মোস্তাফিজুর রহমান
মোস্তাফিজুর রহমান

আরও একটু সহযোগিতা আশা করছি
মোস্তাফিজুর রহমান, চামড়াজাত পণ্যের উদ্যোক্তা

করোনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, সেটা আসলে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে আমরা পাব, এটা চলতি মূলধন। এই ঋণ খাটিয়ে কিছু আনতে পারব, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি করোনার কারণে আরও অনেক দিন ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয়, তাহলে সামনে এই ঋণের বোঝাও টানতে হবে।

করোনার ধাক্কা বাংলাদেশে এসেছে মার্চে, অথচ আমি এবং আমার মতো যারা পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, তারা সেই ধাক্কা আরও আগে থেকেই খাচ্ছে। বছরের শুরুতে আমার চীনে তিনটা অর্ডার ছিল, করোনার কারণে একটি ক্রেতা বাতিল করে দিয়েছে, দুটি এখনো স্থগিত আছে। ভেবেছিলাম, যা-ই হোক, দেশের বাজার দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেব, কিন্তু সবচেয়ে বড় বাণিজ্যের সময় ঈদ ধরা সম্ভব হয়নি। এখন যদিও একটু একটু করে কারখানা খুলছি, কিন্তু ক্রেতা না থাকলে কী তৈরি করব আর কেন তৈরি করব?

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২৫ ভাগ অবদান রাখে। আয় ও কর্মসংস্থান উভয় দিক থেকেই এর গুরুত্ব আছে। করোনায় বাণিজ্যক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তারা, অন্য কোথাও থেকে টাকা এনে টিকে থাকব, সেই সংগতিও নেই। ভেবেছিলাম, হয়তো এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এই বছরের বাজেটে আমাদের জন্য বিশেষ সহযোগিতা রাখা হবে। কিন্তু দেখা গেল, শিল্প ও অর্থনৈতিক খাতেই বরাদ্দ কমে গেছে। আশঙ্কা করছি, আমাদের মতো ছোটরা গণনার বাইরেই থেকে যাবে।

আমার তিনটা ছোট আউটলেট ছিল, ফেব্রুয়ারিতে একটা বড় আউটলেট বায়না করেছিলাম। ঈদের আগের চুক্তি বাতিলে বাধ্য হই। সেই টাকা দিয়ে পুরোনোগুলোর ব্যয়ে এবং কর্মীদের বেতনে ভর্তুকি দিচ্ছি।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেই এসএমই খাতে সরকারের বরাদ্দ অনেক বেশি। স্বাভাবিক সময়ে তো বটেই, করোনার সময়ে আমরা আরও একটু সহযোগিতা আশা করি। আমাদের অসফল হওয়া মানে আমাদের একার অসফলতা নয়। আমরা সংখ্যায় অনেক। আমরা বিফল হলে অর্থনীতিও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বাজেট পাস করার আগে আরও একবার আমাদের কথা ভাবার অনুরোধ করছি।

সৈয়দ আরেফিন হাসান
সৈয়দ আরেফিন হাসান

মুঠোফোনের বাড়তি কর তুলে নেওয়া হোক
সৈয়দ আরেফিন হাসান, ব্যাংকার
এবারের বাজেটের সবচেয়ে খারাপ দিক আমার কাছে মনে হয়েছে মুঠোফোন সেবার ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাবটি। এর প্রভাব সমাজের উচ্চবিত্তের ওপর যেমন পড়বে, তেমনি একজন রিকশাচালককেও এ বাড়তি কর গুনতে হবে। সবাই যে মুঠোফোনে অপ্রয়োজনে কথা বলেন, তা নয়। জরুরি প্রয়োজনের কথাই বেশি বলা হয়। তারপরও সরকার যদি কথা বলা বা মুঠোফোনের অন্যান্য সেবার ওপর কর বাড়াতে চায়, তার জন্য নির্দিষ্ট একটি সীমা বেঁধে দিতে পারে। ধরা যাক, সরকার ঠিক করল, কেউ যদি দিনে সব মিলিয়ে এক ঘণ্টার বেশি ফোনে কথা বলেন, তাহলে বাড়তি কর দিতে হবে। সেটি হলে গরিব মানুষের ওপর এ করের বোঝা চাপত না।

এ ছাড়া গাড়ির মালিকদের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে। একদিক থেকে এটাকে আমি সমর্থন করলেও অন্যদিক থেকে এটি সমর্থন করতে পারছি না। কারণ, বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বিলাসী পর্যায়ে নেই।

দুর্বল গণপরিবহনব্যবস্থার কারণে দেশের অনেক মধ্যবিত্ত লোক এখন গাড়ি ব্যবহার করেন। সরকার গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নতি করে গাড়ির ওপর কর বাড়ালে তাতে আপত্তির কিছু থাকত না।

একজন ব্যাংকার হিসেবে আমার কাছে এবারের বাজেটের আরেকটি খারাপ দিক মনে হয়েছে ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি জমা থাকলে বাড়তি করারোপের বিষয়টি। এতে ব্যাংকে আমানত কমে যেতে পারে। এমনিতে সুদের হার কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো আমানত-সংকটে ভুগছে। তার মধ্যে আমানত আরও কমলে তার নেতিবাচক প্রভাব পুরো অর্থনীতির ওপর পড়বে। এ ছাড়া বাংলাদেশে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত ব্যক্তির পরিবার আছে, যারা ব্যাংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রেখে তার বিপরীতে প্রাপ্ত সুদ দিয়ে সংসার চালায়। তাদের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

এর বাইরে করোনার কারণে আমার প্রত্যাশা ছিল সরকার স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ নজর দেবে এবার। কিন্তু বাজেটে আমি তার প্রতিফলন খুব একটা দেখিনি। আমি মনে করি, স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর দাবি এখন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের। কিন্তু তার জন্য সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত আমরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। স্বাস্থ্য খাতের বাজেট সংকটের চেয়ে দুর্নীতির সমস্যা প্রকট। তাই শুধু টাকা দিয়ে সংকট দূর করা যাবে না। সংকট কাটাতে হলে টাকার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে আমরা দেখব হাজার টাকার পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) কয়েক গুণ বেশি দামেই কেনা হবে। এ করোনার অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের কাছে আমার একটাই চাওয়া, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার খাতগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক।

এবারের বাজেটে সরকার দেশি শিল্পের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সেটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ, বর্তমান বাস্তবতায় দেশীয় শিল্প না টিকলে, সুরক্ষা দেওয়া না হলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে না। কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কর বাড়ানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকেও আমি সমর্থন জানাচ্ছি।

কৃষকের সুরক্ষায় বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। আমার মনে হয়, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাই তাঁদের জন্য বড় সুরক্ষা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। আমি মনে করি, মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট থেকে কৃষককে বের করে আনতে হবে। কৃষিপণ্যের বিকল্প ও শক্তিশালী বিপণনব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যেখানে পণ্যের বিক্রেতা কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ গড়ে উঠবে।

তানিয়া কালাম
তানিয়া কালাম

আশা করেছিলাম, স্বাস্থ্য খাত গুরুত্ব পাবে, সেটি হয়নি
তানিয়া কালাম, বেসরকারি চাকরিজীবী

একজন চাকরিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে এবারের বাজেটে আমার জন্য স্বস্তির ছিল করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ানোর খবরটি। পাশাপাশি করহারও কিছুটা কমানো হয়েছে। এটি ভালো হয়েছে। যদিও আমি মনে করি, করমুক্ত আয়সীমা আরও কিছুটা বাড়ানো উচিত।

আর সবচেয়ে মন্দ দিক যেটা মনে হয়েছে, সেটি হলো ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলেই বাড়তি কর বসানো হয়েছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত অনেকেই আছেন সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যাংকে রেখে সেই টাকায় সংসার চালান। সরকারের এ সিদ্ধান্তে তাঁদের আয় কমবে। তাই আমি মনে করি, দেশের অবসরপ্রাপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের এ বাড়তি করের বোঝা থেকে সরকার রেহাই দেবে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে সরকার কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু গ্রামে–গঞ্জে অনেকে আছেন, যাঁদের পক্ষে এটি করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই এ ক্ষেত্রেও বিকল্প কী করা যায়, তা সরকারের ভাবা উচিত।

তবে করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতে সরকার এবার বিশেষ নজর দেবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু সেটির কোনো প্রতিফলন দেখলাম না। সরকার যদি দেশের সব হাসপাতালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউসহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করার ঘোষণা দিত, তাহলে খুবই ভালো হতো। আমি প্রত্যাশা করি, সরকার এবার স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তনে বিশেষ নজর দেবে। শুধু হাসপাতাল ভবন না বানিয়ে প্রয়োজনীয় ও আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি চিকিৎসা গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করবে দেশের বড় বড় জেলা শহরে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই এত দিন টাকার পেছনে ছুটেছেন, আশা করছি করোনার এ শিক্ষায় এখন সবাই জীবন নিয়েও ভাববেন। আমরা দেখে আসছি, অনেক বছর ধরে সরকার পোশাক খাতকে নানা ধরনের ভর্তুকি ও সুযোগ–সুবিধা দিয়ে আসছে। আমি মনে করি, এখন ওষুধ খাতকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া দরকার। ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী হয়, তার জন্য বিশেষ প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়া দরকার। করোনাই শেষ কথা নয়, এরপরও আর খারাপ সময় আসতে পারে। তাই স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চাই।

এ ছাড়া আমার চারপাশের মানুষের মধ্যে চাকরি নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠা দেখতে পাচ্ছি। লাভ–লোকসান ব্যবসায় থাকবে। কয়েক মাসের লোকসানের কারণে সবাই চাকরিচ্যুতির পথ বেছে নেবে, এটি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। তাই আমি মনে করি, যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করবে না, সরকার তাদের কিছু কর–সুবিধা দিক।

মো. রাসেল মিয়া
মো. রাসেল মিয়া

বাজেটে আমাদের জন্য কি কিছু বলা আছে?
মো. রাসেল মিয়া, ড্রাইভার

স্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি, ইংরেজিও বুঝি, কিন্তু বাজেট কী বা সেটা কীভাবে আমার জীবনে প্রভাব ফেলবে, তা আমার জানা নেই। করোনার ঝড়ে আমার নাউ (নৌকা) ডুবে গেছে, কোনোরকমে ভেসে থাকার চেষ্টায় আছি। যে বাজেটের কথা বললেন, সেটা আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে বলতে পারেন?

 করোনা আসার আগে আমার জীবন সবচেয়ে ভালো চলছিল। আগে বাসাবাড়িতে ড্রাইভারের কাজ করতাম। তাঁরা বেতন আর খাওয়া দিত। ঢাকায় থাকার খরচটা করে আর বাড়িতে কিছু পাঠিয়ে কিছু টাকা জমত। নিজের কিছু জমানো টাকা আর বাড়িতে জমি বন্দক রেখে ঋণ করা টাকা মিলিয়ে পুরানো একটা নিশান গাড়ি কিনে ফেলি। করোনা আসার আগের চার মাস সেই গাড়িটাই চালাতাম। মাসে চল্লিশ হাজার টাকা কামাইও করেছি। করোনা না আসলে দুই–তিন বছরেই এই টাকা উঠে আসত, কিন্তু করোনা আসায় সব এলোমেলো হয়ে গেল।

 ভাড়া গাড়ি চালানো বন্ধ হওয়ায় কামাই খুবই কমে যায়, কিন্তু ঋণের বোঝা টানতে হতো। আমার ছয় মাসের একটা বাচ্চা আছে, নিজেরা না খেয়ে থাকা যায়, বাচ্চাকে না খাইয়ে রাখা যায় না। হাতে সঞ্চয় ছিল না একদমই, দ্বিতীয় মাসেই বাধ্য হই গাড়ি বিক্রি করে দিতে। এতে অন্তত ঋণের বোঝা নামে, জমি ফেরত পাই। সেখানে বাবা চাষবাস শুরু করেছেন, আমি আবার ঢাকা ফিরে এসেছি। শুনেছি, অফিস–আদালত খুলেছে, যদি কোনো বাড়িতে আবার কাজ পাওয়া যায়।

 শুরুতে যখন আমি কাজ হারাই, ভাবতাম, অন্যের গাড়ি চালানোর কাজ না ছাড়লে হয়তো এত সমস্যায় পড়তাম না। ঢাকা ফিরে বুঝলাম যাঁদের বাসায় আমি বা আমার মতো অন্য ড্রাইভাররা কাজ করে, তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যও খারাপ চলছে। অনেকেই ঈদে ড্রাইভারদের বোনাস দেননি। কারও বাসায় একাধিক ড্রাইভার থাকলে একজনের চাকরি চলে গেছে। আমরা সবাই একই ঝড়ে আছি, কারও নাউ (নৌকা) আগের ডুববে কারও পরে, কিন্তু ঝড় না থামলে সবাই ডুবে যাব।

 কত মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নেয় ফেরত দেয় না, ব্যাংক থেকে টাকা চুরি হয়ে যায়, সেই টাকার কোনো খোঁজ হয় না। আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাইও না। যেভাবে ঋণ পাই, সেটা ফেরত দেওয়ার তাড়া থাকে। যে বাজেটের কথা বললেন সেখানে কি আমাদের জন্য কিছু বলা আছে? জানেন কিছু?

মাহবুবা হক জেবা
মাহবুবা হক জেবা

বাজেট এলেই আতঙ্ক আসে
মাহবুবা হক জেবা, গৃহিণী, বসুন্ধরা রেসিডেনশিয়াল এলাকা

বাজেট এলেই একটা আতঙ্ক আসে। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। যেহেতু মানুষের কল্যাণেই বাজেট। আমার মনে হয়, এই আতঙ্কের ধারা থেকে আমাদের বের হওয়া উচিত এবং সেখানে সরকারকে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে কল্যাণের বিষয়গুলো আরও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা যায়। শুধু অনেক বড় বড় নম্বর আতঙ্কই তৈরি করে।

বাজেটের লক্ষ্য যদি জনগণের উন্নয়ন হয়ে থাকে, তাহলে বলব ২০২০–২১–এর প্রস্তাবিত বাজেটে আরও কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ থাকা দরকার ছিল, যেগুলো এই কোভিড-১৯–এর সময় মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে আসবে। চারদিকে মানুষের চাকরি হারানোর সংবাদ পাচ্ছি। প্রতিদিনই মানুষ বেকার হচ্ছে। আমাদের মতো দেশে এটি খুবই ভয়ংকর সংবাদ। অথচ বাজেটে এটি নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ শুনিনি।

সার্বিকভাবে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ভীষণভাবে কোভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দরকার। তাদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি বড় আকারে বাজেটে দেখা যায়নি। কোনো সন্দেহ নেই, এই কঠিন পরিস্থিতিতে সরকারের টাকা দরকার। আর টাকা যেহেতু জনগণের উন্নয়নেই ব্যয় হবে, সেহেতু যেসব খাত এখন জরুরি না, সেসব খাতে বরাদ্দ কমিয়ে মানুষের জরুরি সামাজিক নিরাপত্তায় আরও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং থাকা দরকার, যেন বাজেটে বরাদ্দের সুবিধা জনগণের কাছে সত্যিকারভাবে পৌঁছাতে পারে।

প্রতিবছরই আমরা বিশাল অঙ্কের বাজেট ঘোষণা শুনি। কিন্তু সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে মানুষের কাছে সত্যিকার সুবিধা পৌঁছানোর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত চিত্র আমরা করোনার সময় দেখতে পেয়েছি। এ খাতে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে এবারের বাজেটে। আমি মনে করি, সরকার যদি চায়—সঠিকভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করে এ দেশে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। বিদ্যুৎ খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতে দ্রুত উন্নয়নে বাজেটের সঠিক বরাদ্দের বাস্তবায়ন চাই। মোবাইলসহ কিছু জরুরি সেবার কর বাড়ানো হয়েছে। এসব উদ্যোগ মানুষের এই ক্রান্তিকালে না নেওয়াই উচিত। কেননা এখন আমরা মুঠোফোনেই ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছি, শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছি।

ঘাটতি বাজেটের অঙ্কটি বিশাল। এটি মেটাতে নানাভাবে জনগণের ওপরই করের চাপ আসবে। এটা তো বোঝাই যায়। চূড়ান্ত বাজেটে এটি মেটানোর উপায় আরও পরিষ্কার করা দরকার। সার্বিকভাবে মেগা প্রকল্পগুলো চালু রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই বাজেটে কার্যকর হবে তখনই, যদি এর স্বচ্ছ বাস্তবায়ন হয়। বাজেটে অনেক প্রণোদনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকায় এই সব প্রণোদনার যেন মানুষের কাজে আসে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রণোদনার বিষয়টি বাজেট বরাদ্দের পর কীভাবে জনকল্যাণে নিশ্চিত হবে, সেটির দিক নির্দেশনাও একসাথে বাজেটে থাকা উচিত।

নাবিলা নওরিন
নাবিলা নওরিন

নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বড় বরাদ্দ প্রয়োজন
নাবিলা নওরিন, সহ–উদ্যোক্তা, মোড়

প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি। বিশাল ঘাটতির বাজেট টেকসই হবে না। এই জায়গা থেকে বের হতে হবে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায় না বাড়লেও প্রতিবছরই সরকারের খরচ বাড়ানো হচ্ছে। এটি যুক্তিসংগত না। আমি খরচ বৃদ্ধির বিপক্ষে না। তবে তার আগে রাজস্ব আদায় কীভাবে বাড়ানো যায়, সেখানে নজর দিতে হবে।

করোনার কারণে নতুন উদ্যোক্তারা খুবই বিপদে আছেন। তাঁদের টিকিয়ে রাখতে আলাদাভাবে কোনো বরাদ্দ নেই বাজেটে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁদের সহায়তা খুবই দরকার। তা ছাড়া নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রতিবছরই বাজেটে বড় অঙ্কের বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কখনই সেটি করা হয়নি। অথচ সরকারের অনেক অগুরুত্বপূর্ণ খাতে বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বরাদ্দ কমিয়ে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্যয় করা যায়। সেই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। তাতে চাকরির বাজারের ওপর চাপ কমবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছেন। তবে কোথায় খরচ হবে সেটি চূড়ান্ত হয়নি। এটি এক অর্থে ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে। কারণ দুই–তিন মাসে কার্যকর পরিকল্পনা করা যায় না। আশা করব, সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রস্তুত করার পরই করোনা মোকাবিলায় এই ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে সরকার।

করোনার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সরকার তাঁদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তবে সেখান থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, অধিকাংশ উদ্যোক্তারই ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন নেই। তাই অন্যভাবে সহযোগিতা করা যেতে পারত। তবে বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আমার মনে হয়, যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় তাদের দোকানভাড়া ও পণ্য সরবরাহের ওপর ভ্যাট কয়েক মাসের জন্য মওকুফ করা যেতে পারে। তাতে কিছুটা হলেও উদ্যোক্তারা স্বস্তি পেতেন।

সরকারের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। তাতে অনেক টাকা বেঁচে যাবে বলে মনে হয়। মাঝেমধ্যে সরকারি প্রকল্পের কেনাকাটায় এমন সব দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে যে তা মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য। তাই নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের অবশ্যই জনগণের টাকার সুষ্ঠু ব্যবহারে দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হতে হবে। না হলে পরিবর্তন আসবে না।