দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা যায়

নোবেল পুরস্কার নেওয়ার মঞ্চে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো
নোবেল পুরস্কার নেওয়ার মঞ্চে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো

পৃথিবীর ধনী দেশগুলোতে অসমতার বিস্ফোরণ ঘটেছে তা ঠিক, কিন্তু গত কয়েক দশকে যে গরিব মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে, তা–ও বলা দরকার। ১৯৮০ থেকে ২০১৬ সাল—এই সময়ে আয়ের নিরিখে নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও অর্ধেকের বেশি কমেছে। ইতিহাসের আর কোনো সময়ে এত মানুষ এত অল্প সময়ে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসেনি।

জীবনমানের উন্নতিও হয়েছে ব্যাপক, এমনকি যারা এখনো গরিব, তাদের জীবনেও এ কথা প্রযোজ্য। ১৯৯০-এর দশকের পর সারা বিশ্বে সন্তান জন্মদানের সময় মাতৃমৃত্যুর হার অর্ধেক কমেছে। নবজাতকের মৃত্যুর হারও একইভাবে কমেছে এবং এতে ১০ কোটির বেশি শিশুর জীবন রক্ষা পেয়েছে। আজ যেসব দেশে বড় ধরনের সামাজিক গোলযোগ নেই, সেই সব দেশের প্রায় সব শিশুই প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। যে এইচআইভি বা এইডস নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে মহামারির রূপ ধারণ করতে শুরু করেছিল, তা–ও এখন কমতে শুরু করেছে।

প্রবৃদ্ধির সন্ধানে
এই অর্জনের বড় একটি অংশের কৃতিত্ব হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদনের ধারাবাহিক ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষে বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও ওষুধের পেছনে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আয় বণ্টনের মাধ্যমে দরিদ্রদের উপার্জন বাড়ানো গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন সবচেয়ে বেশি হয়েছে চীন ও ভারতের মতো বিশাল দুটি দেশে; বলা বাহুল্য, এদের প্রবৃদ্ধির হার যথেষ্ট বেশি। কিন্তু এখন এই দুই দেশের প্রবৃদ্ধির হার কমতে শুরু করায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে। এই স্থবিরতা কাটতে দেশ দুটি কি কিছু করতে পারে? এবং এরা কি অন্যদের অনুসরণ করার মতো এমন কোনো নিশ্চিত সমাধান সূত্র দিতে পারে, যার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব?

আমাদের মতো অর্থনীতিবিদেরা সারা জীবন উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদদের জন্য অস্বস্তিকর সত্যটা হচ্ছে, আমরা এখনো ভালোভাবে জানি না যে বিশেষ বিশেষ দেশের অর্থনীতি কেন সম্প্রসারিত হয় এবং অন্যগুলো কেন হয় না। প্রবৃদ্ধির নিশ্চিত সূত্র নেই। সাধারণ সূত্রের কথা বললে বলতে হয়, পুঁজি ও শ্রমের সবচেয়ে উৎপাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়। কিন্তু অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে একসময় প্রাপ্তির হার কমে যায় এবং তখন ওই দেশগুলোকে দারিদ্র্য দূরীকরণের নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে হয়।

ব্যাপারটা হলো, কোন কোন কারণে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে, তা অনুসন্ধানের জন্য অর্থনীতিবিদেরা শিক্ষা, বিনিয়োগ, দুর্নীতি, অসমতা, সংস্কৃতি, সমুদ্র থেকে দূরত্ব—এসব তথ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু এই অনুসন্ধানের দুটি সমস্যা দেখা যায়। প্রথমত, অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ইস্টারলি দেখিয়েছেন, দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই কোনো একটি দেশের প্রবৃদ্ধির হার কোনো দশকে অনেক বাড়তে পারে, আবার পরের দশকে ধপ করে পড়ে যেতে পারে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্রাজিল ছিল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির সামনের সারিতে, কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে এসে ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় থমকে যায়, তা–ও প্রায় দুই দশকের জন্য (এরপর তার প্রবৃদ্ধি আবার বাড়তে শুরু করে এবং পরে আবার থমকে যায়)। ১৯৮৮ সালে আধুনিক সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট লুকাস বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভারতের অর্থনীতি কেন এতটা শ্লথ, সে কেন মিসর ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশ হয় না। ভাগ্যের কি ফের, ঠিক তখনই ভারতের প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করে এবং পরবর্তী ৩০ বছর অর্থাৎ এখন পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত আছে। অথচ মিসর ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমে যায়। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অনেক উপহাস করা হয়েছে, কিন্তু সেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার এখন ৭ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ২০টি প্রবৃদ্ধির দেশ। এসব ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার বাড়া এবং কমার পেছনে দৃশ্যমান বিশেষ কারণ ছিল না।

দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে বিশেষ কাজ হয় না। একটি দেশের প্রায় সব ভ্যারিয়েবলই অন্য কিছুর ফসল। শিক্ষার কথাই ধরুন, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এর ইতিবাচক আন্তসম্পর্ক আছে। শিক্ষা কিন্তু আংশিকভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা ও তহবিল জোগানোর কাজের অংশ। তবে যে সরকার এই কাজে পটু, সে সম্ভবত অন্যান্য কাজেও পটু, যেমন সড়ক নির্মাণ। এখন কথা হলো, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও সড়ক দুটিই ভালো, কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে ঠিক কী কারণে, শিক্ষা নাকি সড়ক যোগাযোগের কারণে, নাকি বাণিজ্য সহজ হওয়ার জন্য। নাকি এর পেছনে অন্য কারণ আছে? চিত্রটা আরেকটু ঘোলা করে দিই এবার, সেটা হলো, মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হলেই কেবল তারা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়। এর উল্টোটা নয়। সে জন্য নির্দিষ্ট একটি কারণ খুঁজতে যাওয়া বোকামি।

তাহলে নীতিনির্ধারকদের কী করা উচিত? কিছু কিছু ব্যাপার পরিষ্কারভাবেই পরিহার করা উচিত: অতি মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অতি মূল্যায়িত ও নির্ধারিত বিনিময় হার, সোভিয়েত, মাওবাদী ও উত্তর কোরিয়ার ধাঁচের সমাজতন্ত্র, বেসরকারি উদ্যোগে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ; ১৯৭০-এর দশকে ভারতে যা ছিল—জাহাজ কারখানা থেকে জুতার কারখানা—সবই তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন এটা জানতে চায় না যে তাদের সবকিছু রাতারাতি জাতীয়করণ করা উচিত, নাকি চীনের অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করা উচিত। চীন বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করলেও তারা ঠিক যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। এমনকি সে ইউরোপের মতোও নয়। চীনা সরকার জাতীয় ও এমনকি স্থানীয় পরিসরেও ভূমি, পুঁজি ও শ্রম বণ্টনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু চীন নয়, পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান প্রথাগত পুঁজিবাদী মডেল পরিহার করেও বছরের পর বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এসব দেশের সরকার নিজেই সক্রিয়ভাবে শিল্পনীতি প্রণয়ন করেছে।

কথা হচ্ছে, এসব দেশ অপ্রচলিত নীতি অনুসরণ করে লক্ষণীয় সফলতা পেয়েছে। এরা কি পরিকল্পিতভাবে এই নীতি অনুসরণ করে সফল হয়েছে, নাকি তাদের পরিকল্পনাই ছিল না, অর্থাৎ বকটা কি ঝড়েই মরেছে, নাকি নীতিপ্রণেতাদেরও এতে কৃতিত্ব আছে? এই দেশগুলো আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়েছে। ফলে তাদের এই উত্থানের সঙ্গে আবার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গও জড়িয়ে আছে। মোদ্দাকথা হলো, দরিদ্র দেশগুলোর উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের নির্দিষ্ট সূত্র নেই, বিশেষজ্ঞরাও এটা মেনে নিয়েছেন।

বিশ্বব্যাংক ২০০৬ সালে অর্থনীতিবিদ মাইকেল স্পেনসের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিশন গঠন করে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কমিশন স্বীকার করে নেয় যে প্রবৃদ্ধির সাধারণ নীতি নেই এবং প্রবৃদ্ধির দুটি নজির কখনোই এক হয় না। ইস্টারলি আরও চাঁছাছোলাভাবে কমিশনে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিবৃত করেছেন: ‘কমিশনে ২১ জন বিশ্বনেতা ও বিশেষজ্ঞ, ১১ সদস্যের কার্যকরী গ্রুপ, ৩০০ একাডেমিশিয়ান, ১২টি কর্মশালা, ১৩টি পরামর্শ সভা ও ৪০ লাখ ডলারের বাজেট ফুরিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, আমরা এর কারণ জানি না। তবে বিশেষজ্ঞরা এর কারণ খুঁজে বের করবেন বলে আস্থা রাখি।’

চোখটা যখন পুরস্কারে
চীন ও ভারতে প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে। এ নিয়ে আমাদের তেমন কিছু করারও নেই। আবার এমন হতে পারে যে অন্য কোনো দেশে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে পারে, কিন্তু এটা কেউ বলতে পারে না যে তা কোথায় এবং কেন বাড়বে। ভালো খবরটা হলো, প্রবৃদ্ধির হার ভালো না হলেও অগ্রগতির অন্যান্য সূচকে উন্নতি ঘটানোর সুযোগ আছে। নীতিপ্রণেতাদের বুঝতে হবে, জিডিপি মূল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়মাত্র। পদ্ধতি হিসেবে এটি প্রয়োজনীয় সন্দেহ নেই। কেননা এতে যেমন কর্মসংস্থান হয়, তেমনি মজুরি ও বাজেট বাড়ে, সরকারের হাতেও পুনর্বণ্টনের মতো অনেক টাকা আসে। কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্যটা হলো মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, বিশেষ করে সেই মানুষদের, যাদের জীবন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত।

জীবনমান কিন্তু আবার স্রেফ ভোগ নয়। সন্দেহ নেই, উন্নত জীবনের একটি মানে হলো বেশি ভোগ করতে পারা। আবার এটাও সত্য যে অনেক মানুষই শুধু এর মধ্যে সীমিত থাকতে চান না, সবচেয়ে গরিব মানুষের বেলায়ও এটি সত্য। মানুষ সম্মান চায়, চায় পিতামাতাকে স্বাস্থ্যবান রাখতে; সন্তানকে শিক্ষিত করা, নিজের মতামত প্রকাশ করা ও স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চায় তারা। উচ্চ হারের জিডিপির কল্যাণে গরিবেরা এর অনেক কিছুই অর্জন করতে পারে, কিন্তু এটাই সব নয়। সুখ লাভের শ্রেষ্ঠ পথও নয়। বস্তুত সমপরিমাণ আয়ের দুটি দেশে জীবনমান একই রকম না–ও হতে পারে, যেমন শ্রীলঙ্কা ও গুয়াতেমালার কথাই ধরা যাক। দুটি দেশের আয় প্রায় একই হলেও শ্রীলঙ্কায় মাতৃমৃত্যু হার, নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক কম। এই বৈষম্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, গত কয়েক দশকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কল্যাণে অর্জিত হয়নি। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার বদৌলতে এটি অর্জিত হয়েছে, এমনকি অনেক চরম দরিদ্র দেশেও তা সম্ভব হয়েছে, দারিদ্র্য এখানে বাদ সাধতে পারেনি।

অন্যদিকে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর হার সারা পৃথিবীতেই কমেছে, যেসব দেশের প্রবৃদ্ধির হার অত বেশি নয়, সেসব দেশেও। এই শিশুমৃত্যুর হার কমে আসার মূল কারণ হলো নবজাতক শিশুর জীবনরক্ষায় নীতিপ্রণেতাদের বিশেষ গুরুত্বারোপ—যত্নআত্তি থেকে শুরু করে টিকাদান কর্মসূচি ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি। জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগে—এমন সবকিছুতেই এই মনোভঙ্গি প্রয়োগ করা উচিত, তা সে শিক্ষাই হোক বা দক্ষতা, উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

এই কাজে ধৈর্য প্রয়োজন। কেবল টাকা ঢাললেই যে মানসম্মত শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। তবে প্রবৃদ্ধির পথ নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা এটা জানেন, কীভাবে অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার বড় একটি সুবিধা হলো, এগুলো কতটা বাস্তবায়িত হলো, তা পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা সম্ভব। গবেষকেরা এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। যে নীতি কাজে আসছে না, তা যেমন বর্জন করতে পারেন, তেমনি যেটা কাজে আসছে, তার উন্নতি ঘটাতে পারেন। ক্যারিয়ারের বড় একটি অংশজুড়েই আমি এই কাজ করেছি। আজ আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব, জে-পল, ইনোভেশন ফর পভার্টি অ্যাকশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হয়ে শত শত গবেষক এই কাজ করছেন।

এখন ব্যাপার হলো, কেনিয়াকে কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়া বানানো যায়, তা আমরা না জানলেও জেসিকা কোহেন ও প্যাক্সেলিন ডুপাসের গবেষণায় আমরা জেনেছি, ওষুধমিশ্রিত মশারিই হচ্ছে ম্যালেরিয়া দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। একসময় মনে করা হতো যে টাকার বিনিময়ে এই মশারি দেওয়া হলে লোকে ব্যাপক হারে কিনবে। কিন্তু দৈবচয়নের ভিত্তিতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই দুই গবেষক দেখিয়েছেন, এতে মশারির ব্যবহার উল্টো কমেছে। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৫৮ কোটি ২০ লাখ ওষুধমিশ্রিত মশারি সারা বিশ্বে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিনা মূল্যে গণবিতরণ পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন বেঁচেছে।

বাচ্চাদের সঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো
বাচ্চাদের সঙ্গে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো

প্রবৃদ্ধির সীমা পেরিয়ে
মোদ্দাকথা হলো, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল টোটকা কী, তা আজও রহস্যাবৃত। কিন্তু দরিদ্র দেশের অর্থনীতিতে অপচয়ের সবচেয়ে বাজে জায়গাগুলো কী এবং মানুষের কষ্টের কারণগুলোই–বা কী, তা চিহ্নিত করে নিরসনের অনেক চেষ্টাই করা যায়। যেমন প্রতিরোধযোগ্য রোগে শিশুরা মারা যায়, স্কুলে শিক্ষকদের না যাওয়া, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা—এসব মানুষের উৎপাদনশীলতা বিনষ্ট করে এবং জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। আবার এসব সমস্যার সমাধান হলেই যে কোনো দেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করবে তা নয়, তবে এতে নাটকীয়ভাবে মানুষের কল্যাণ হতে পারে। 

এ ছাড়া যদিও কেউ জানে না কখন একটি দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করবে, এই প্রবৃদ্ধির সময় গরিব মানুষের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে বা তাদের সাক্ষরজ্ঞান থাকে কিংবা তারা নিজেদের পারিপার্শ্বিক জগতের বাইরে চিন্তা করতে পারে, তাহলে সেই উন্নয়নের ট্রেনে তারা সহজেই উঠে যেতে পারবে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের সবচেয়ে বেশি উপকারভোগী দেশগুলো যে কমিউনিস্ট, সেটাও আপতিক নয়। এরা আবার আদর্শগত কারণেই মানবসম্পদ উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, যেমন চীন ও ভিয়েতনাম। আবার দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলো কমিউনিজমের ভয়ে একই নীতি অনুসরণ করেছে।

এ কারণে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে বিদ্যমান সম্পদ দিয়ে জীবনমানের উন্নয়ন করা; অর্থাৎ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করা এবং একই সঙ্গে আদালত ও ব্যাংকের মানোন্নয়ন, উন্নত সড়ক ও বসবাসের উপযোগী শহর নির্মাণ করা। ধনী দেশগুলোর জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। এদের আবার দরিদ্র দেশের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি বিনিয়োগ করা উচিত। উন্নয়নের জাদুমন্ত্র নেই। তাই শুধু প্রবৃদ্ধিতে জোর দেওয়া বৃথা, এর চেয়ে বরং প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যা অর্জিত হয়, জোর সেখানেই দেওয়া উচিত—গরিব মানুষের কল্যাণ।

অনুবাদ প্রতীক বর্ধন, ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডট কম থেকে নেওয়া। সংক্ষেপিত।