দায় অনেকের, শাস্তি শুধু অপারেটরের

মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবায় চারটি বিষয় যুক্ত। একটি শুধু অপারেটরের হাতে। নানা সমস্যা, সমাধান নেই।

ফাইল ছবি

মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিতে মোটা দাগে চারটি বিষয়ে জোর দেওয়া জরুরি—বাড়তি তরঙ্গ, বাড়তি টাওয়ার, উন্নত আন্তসংযোগ ব্যবস্থা ও অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক। টেলিযোগাযোগ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই চার ক্ষেত্রের তিনটিতে এখনো নানা সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না। বরং অপারেটরকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর গ্রামীণফোনের সিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি গত সপ্তাহে গ্রামীণফোনের (জিপি) সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চিঠি দেয়। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশে চারটি অপারেটর রয়েছে: গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক। বছর চারেক ধরে সার্বিকভাবে টেলিযোগাযোগ খাতের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিপরীতে অপারেটররা বারবার বলছে, সমস্যার সমাধান না হলে সেবার মান উন্নয়ন কঠিন।

মানুষ ভোগান্তিতে আছে। এ নিয়ে আমাকে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতেই হবে।
মোস্তাফা জব্বার, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, সেবার মানের ক্ষেত্রে পুরোটা অপারেটরের ওপর নির্ভর করে না, এটা ঠিক। তবে বেশির ভাগটাই অপারেটরের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ‘মানুষ ভোগান্তিতে আছে। এ নিয়ে আমাকে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতেই হবে।’ সরকার কারও ব্যবসা বন্ধ করতে চায় না বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, গ্রামীণফোন আরও নতুন গ্রাহক নিলে তাদের সেবার মান আরও খারাপ হবে। বিটিআরসি তাদের সেবা বন্ধ করেনি, নতুন গ্রাহক নেওয়া বন্ধ করেছে।

মানসম্মত সেবা যে চারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে একটি শুধু অপারেটরদের হাতে রয়েছে। সেটি হলো তরঙ্গ কেনা। ২০২১ সালের মার্চ ও গত মার্চে দুই দফা নিলামে অপারেটরগুলো বিটিআরসির কাছ থেকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার তরঙ্গ কিনেছে। তাদের দাবি, তরঙ্গের সমস্যা নেই। অবশ্য টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মনে করেন, শুধু তরঙ্গ নিলে হবে না, সেটা ব্যবহার (রোল আউট) করতে হবে।

আরও পড়ুন

তরঙ্গ কেনার পর দরকার বাড়তি সংখ্যক বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস), যা টাওয়ার নামে পরিচিত। উন্নত মানের অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কও জরুরি। ২০১১ সালে বিটিআরসি অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বসানোর ক্ষমতা শুধু ন্যাশনওয়াইড ট্রান্সমিশন (এনটিটিএন) অপারেটরদের দেয়। ২০১৮ সালে টাওয়ার বসানোর ক্ষমতা দেওয়া হয় শুধু চারটি টাওয়ার কোম্পানিকে, যারা অপারেটরদের প্রয়োজন অনুযায়ী টাওয়ার বসাবে। কিন্তু চুক্তিজনিত জটিলতায় প্রায় দুই বছর তেমন কোনো টাওয়ার বসেনি।

টেলিযোগাযোগ খাতে সেবার মান খারাপ, এটা হলো রোগ। রোগের কারণ না খুঁজে কারও সিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত।
আবু সাঈদ খান, জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো, লার্নএশিয়া

অপারেটরগুলো গত মে মাসে প্রথম আলোকে জানায়, টাওয়ার কোম্পানির মাধ্যমে টাওয়ার বসাতে চাইলেও তারা পারছে না। কারণ, রাজধানীতে টাওয়ার বসানোর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সরকারি সংস্থাও তাদের ভবনের ছাদে টাওয়ার বসাতে দেয় না। তখন গ্রামীণফোন জানিয়েছিল, ঢাকায় অন্তত ১১৬টি এলাকায় অতিদ্রুত টাওয়ার বসানো দরকার। রবি জানিয়েছিল, ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাদের ২৭০টি টাওয়ার বসানো খুবই জরুরি। আর বাংলালিংক বলেছিল, তাদের দরকার ১৩০টি টাওয়ার।

এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়েছে কি না জানতে চাইলে একটি অপারেটরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসিকে জানানোর পর তারা তিনটি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অপারেটরদের সহযোগিতা করার অনুরোধ করেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান আসলে হয়নি। তিনি আরও বলেন, চার টাওয়ার কোম্পানির তিনটির তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই।

অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক বিষয়ে আরেকটি অপারেটরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৮ হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক কাজে লাগানো যাচ্ছে না ব্যান্ডউইডথ ব্যবস্থাপনার যন্ত্র (ডিডব্লিউডিএম) কিনতে না পারায়। অপারেটরদের এই যন্ত্র কেনা নিষিদ্ধ। কিন্তু অপটিক্যাল ফাইবার সেবাদাতারাও সেটা কিনে দিচ্ছে না।

বিপাকে গ্রামীণফোনের গ্রাহক

চার মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরের মধ্যে গ্রাহক, রাজস্ব ও মুনাফার দিক দিয়ে গ্রামীণফোন দেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর। এটি দেশের শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠানের একটি। গত মে মাস শেষে অপারেটরটির গ্রাহক দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণফোন দেশের ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পেরেছে। গ্রামীণফোনের শেয়ারধারীদের মধ্যে রয়েছে নরওয়ের টেলিনর (৫৬ শতাংশ) ও গ্রামীণ টেলিকম (৩৪ শতাংশ)। দেশের পুঁজিবাজারে ১০ শতাংশ শেয়ার ছেড়েছে গ্রামীণফোন।

গ্রামীণফোনের মাসিক সিম বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের দৈনিক গড় সিম বিক্রি দুই হাজারের বেশি। বিটিআরসি বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রাহকেরা সিম কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণফোনের সিম কিনতে যাওয়া গ্রাহক শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে থাকা মায়ের জন্য একটি মুঠোফোন ও সিম কিনবেন। তাঁর গ্রামে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়। তাই গ্রামীণফোনের সিম কিনতে চান।

সিম কিনতে না পারার কথা জানিয়ে শাহাদাৎ বলেন, কোনো একটি কোম্পানির সেবার মান যদি খারাপ হয়, তাহলে গ্রাহকেরা অন্য কোম্পানির সেবা নেবেন। দেশে তো সেটা হচ্ছে না, কারণ সবার সেবার মানই অসন্তোষজনক।

‘এটা হঠকারি সিদ্ধান্ত’

বিটিআরসি গত মার্চে অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে ঢাকা বিভাগে (মহানগর বাদে) একটি পরীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, কলড্রপের হার, কল সংযোগের সময়, সফল কলের হার—এসব ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক মানদণ্ডের ওপরে রয়েছে, অর্থাৎ উত্তীর্ণ হয়েছে। বিটিআরসির পরীক্ষায় বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা বা ফোর–জির গতির ক্ষেত্রে সব অপারেটরই পিছিয়ে থাকে।

টেলিযোগাযোগ খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে সেবার মান খারাপ, এটা হলো রোগ। রোগের কারণ না খুঁজে কারও সিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া একটি হঠকারি সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা এখন টাওয়ার বসাতে পারে না, অপটিক্যাল ফাইবার বসাতে পারে না। টেলিযোগাযোগ খাতে একের পর এক মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছে। সরকারি নীতি যদি ঠিক না থাকে, সেবার মান উন্নত হবে না।