দেশ ও দশের মঙ্গলচিন্তা করলে তাদের জন্য ভালো কিছু করা যায়: মুহিত

শিশুর মতো ‘শিশু’ থেকে দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছিল মিলনায়তনটির চারদিকে। এত দিন খুব বেশি মানুষের জানা ছিল না যে তাঁর ডাকনাম শিশু। এমনকি যাঁরা শুভেচ্ছা জানাতে এলেন, তাঁদেরও অনেকের অজানা। চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ যখন শিশুটির গুণকীর্তন করার এক ফাঁকে বললেন, তখনই সবাই জানলেন যে এই শিশু আর কেউ নন, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের দুবারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ৮৮তম জন্মদিনে আজ মঙ্গলবার চ্যানেল আই তাঁকে ‘সোনার মানুষ’ ও ‘ত্রিকালদর্শী কর্মবীর’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

যেহেতু কোভিড-১৯ এখনো দুনিয়া থেকে চলে যায়নি, ফলে আয়োজনটি সাদামাটা ও আড়ম্বরহীনভাবেই করে চ্যানেল আই। আজ এই কর্মবীরের ৮৮তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে চ্যানেল আই ঢাকার মিন্টো রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তন বেছে নেয়। তবে বসার যত আসন ছিল এতে, তা অর্ধেকে নামিয়ে আনে। মুখে মাস্ক পরা আছে কি না, দেখে দেখে এবং হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় হলঘরে।

অনুষ্ঠানে দর্শকের কাতারে বসে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মুহিতের ছোট ভাই) এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে নিজের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও কর্মময় জীবনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র দেখেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।

শাইখ সিরাজের করা ৫৪ মিনিটের এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে আসে মুহিতের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের প্রতিচ্ছবি। আরও উঠে আসে তাঁর সামাজিক জীবন, শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক জীবন ও দেশ-বিদেশের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের চিত্র।

প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন শেষে এ এম এ মুহিত কথা বলেন সবার উদ্দেশে। উপস্থিত ছিলেন তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সহকর্মীরা।
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আজকের দিনে আমি উপদেশ দিতে চাই না। দেশ ও দশের মঙ্গলচিন্তা করলে তাদের জন্য ভালো কিছু করা সম্ভব। আমি সারা জীবন সেটাই করে এসেছি।’ মুহিত বলেন, ‘আমার দীর্ঘ আয়ু বংশগত। আমার দাদা ৮০ বছর এবং বাবা ৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন।’

একাডেমির পাশেই সবুজ লন। খোলা জায়গায় মুহিতের ৮৮তম জন্মদিনের কেক কাটা হয়। সঙ্গে ছিল পিঠা ও বিভিন্ন ফলের আয়োজন। মুহিতের বন্ধু মোকাম্মেল হক বলেন, ‘মুহিত একজন অজাতশত্রু মানুষ। শুধু প্রজ্ঞা, মনীষা ও শিক্ষাদীক্ষায় তিনি অগ্রসর নন, খেলাধুলা, বিতর্ক ও সংস্কৃতির প্রতিও তাঁর অপার টান ছিল এবং এখনো আছে।’
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘কিছুটা হলেও তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছি। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ সমাজে বিরল।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষক।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবদুল মুহিত বরাবরই একজন মেধাবী মানুষ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার আগে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৬ সালে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বর্ণাঢ্য জীবন

সিএসপি হওয়ার পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি পরিকল্পনাসচিব হন। তার আগে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি পরিচিত ব্যক্তি। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরে মুহিত হলেন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।

১৯৭৭-৮১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন তিনি এবং ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্তটি ছিল নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

এরশাদ কথা না রাখলে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তা দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে মুহিত বই লিখেছেন ৩৫টি। এখনো লিখে চলেছেন। সময় পেলেই ছবি দেখেন। গান শোনেন। সারা রাত জেগে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে দেখা গেছে তাঁকে বহুবার। মহানায়িকাখ্যাত সুচিত্রা সেন অভিনীত সব চলচ্চিত্রই তাঁর প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্র অবশ্য ‘রোমান হলিডে’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া মার্কিন এই রোমান্টিক কমেডি চলচ্চিত্রে বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন অভিনয় করেন।

২০১৭ সালে জন্মদিন উপলক্ষে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, সুযোগ পেলেই প্যারিসে লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি ‘মোনালিসা’ দেখতে যান তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘ভিঞ্চি এমন একটি মেয়েকে আঁকলেন এবং এমনভাবে আঁকলেন, যে ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হয়, আমার দিকে চেয়ে হাসছে এবং আমার জন্যই হাসছে।’