বিদ্যুতের সংযোগ পেতে ভারতে লাগে ১০৬ দিন। আর বাংলাদেশে ৪২৯ দিন। ভারতে ৪৭ দিনে জমির নিবন্ধন পাওয়া গেলেও এ দেশে লাগে ২৪৪ দিন। আর লেনদেনের ব্যয় তো এমনিতেই অনেক বেশি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করা সহজ নয়।
এসব কারণে এ দেশে যতটা বিদেশি বিনিয়োগ আসার কথা, ততটা আসছে না। বিনিয়োগে আগ্রহ কমে গেছে দেশীয় উদ্যোক্তাদেরও।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত সেমিনারে এমন অভিমত উঠে এসেছে। রাজধানীর বনানীতে সংস্থাটির কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালে দেশে ১৬০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। কিন্তু তা আশাব্যঞ্জক নয়। ব্যবসা করার পরিবেশের দিক থেকে প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। আইএফসির তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ পাওয়ার দিক থেকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৮, সম্পত্তি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ১৮৮তম, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১৪০তম, নির্মাণকাজের অনুমতির ক্ষেত্রে ১৪৪, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৩১তম। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। তাই অনেকেই বিদেশে টাকা পাচার করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অন্যান্য সংস্থা তা বন্ধ করতে পারছে না।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ না পাওয়াকে বিনিয়োগের বড় বাধা উল্লেখ করে সাদিক আহমেদ বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশি বিনিয়োগকারীরাই বিনিয়োগ করছে না। বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে আসবে? জ্বালানির সংকট দূর করতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আরেকটি বড় সমস্যা জমি। এর দাম হু হু করে বাড়ছে। দেশে সনাতনী প্রক্রিয়ায় ভূমির নথি সংরক্ষণ, দুর্বল আইন এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়াও ব্যয়বহুল। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
সাদিক আহমেদ আরও বলেন, একুশ শতকের উপযোগী বিনিয়োগ পেতে এখন শুধু নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়াই (ডিরেগুলেশন) যথেষ্ট নয়, ব্যবসা করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য বিদ্যমান আইনি কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে।
আরেক প্রবন্ধে পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, রপ্তানিতে প্রতিযোগী সক্ষমতা আনতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাণিজ্যকে সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যয় কমানোর জন্যও সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য পরিবহনব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থির হয়ে আছে। এই উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি কেন বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না, তা খুঁজে বের করতে হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বক্তব্য শুরুই করেন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সকালে পোশাকের ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছিলাম। তারা জানতে চাইছে, কী হচ্ছে দেশে? কবে এসবের শেষ হবে?’ তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক (আনলাকি) ছিল। ২০১৪ সালে অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ায় আমরা বিনিয়োগ করেছি। কারখানা কমপ্লায়েন্ট করেছি। ২০১৫ সাল আমাদের সুফল পাওয়ার সময়। কিন্তু সুফল আমাদের হাতে নেই, রাজনীতিকদের হাতে।’
২০২১ সালে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে আতিকুল ইসলাম বলেন, এ জন্য প্রতিদিন ৯০ কোটি ডলারের (৯৬০ কোটি টাকা) পোশাক রপ্তানি করতে হবে। সেভাবে সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। এসব নিয়ে পোশাকমালিকেরা অনেক চাপে আছেন। কিন্তু রাজনীতিকেরা মনে করেন, পোশাক খাতে কোনো সমস্যা নেই।
জমির স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ৬৫ শতাংশ কারখানা শেয়ারড (একই ভবনে অনেক প্রতিষ্ঠান) ভবনে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ কারখানা সরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। সেখানে ১৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। ক্রেতারা সেগুলো সরিয়ে নিতে পাঁচ বছর সময় দিয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর পেরিয়ে গেছে।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবদুল হক বলেন, ‘গত ২০ দিনে দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না। কিন্তু তার পরও আমরা আটকে আছি শুধু নিজেদের সৃষ্ট গোলযোগের কারণে। এমন অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে?’
সেমিনারের প্রধান অতিথি বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এস এ সামাদ বলেন, ‘১৬০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ খুব বেশি না। আমি মনে করি, এটা ৫০০-৭০০ কোটি ডলার হওয়া উচিত।’
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে সেমিনারে সাবেক সচিব ফারুক সোবহান, এমসিসিআইয়ের সহসভাপতি আনিস এ খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।