দেশে বসেই আন্তর্জাতিক ব্যবসা

জুমশেপারের প্রতিষ্ঠাতা কাওসার আহমেদ
ছবি: খালেদ সরকার

জুমশেপারের নাম অনেকেই শুনেছেন। বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা তো বটেই। যদি বলি জুমশেপার থাকছে না, তবে অনেকেরই চোখ কপালে ওঠার দশা হবে। কিন্তু ঘটনা তেমনই।

শোনা যাক জুমশেপারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাওসার আহমেদের মুখ থেকেই। ‘আমরা কোম্পানির নাম বদলে ফেলেছি। নতুন নাম ওলিও। ওলিওর অধীনে অবশ্য জুমশেপার থাকবে। ওলিও হয়ে উঠবে মূল প্রতিষ্ঠান (মাদার কোম্পানি)।’

পাঠক, কোনো কিছুর সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? অ্যালফাবেটের নাম মনে আসছে? গুগলকে সবাই চেনে, এই গুগলই একদিন হয়ে গেল অ্যালফাবেটের অধীনের এক প্রতিষ্ঠান। আর এই তো কদিন আগেই ‘মেটা’ নামে মাদার কোম্পানি তৈরি করল ফেসবুক। কাওসার তাঁর জুমশেপারের মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোগ বা ব্যবসায় নতুনত্ব এনেছেন নানাভাবে, মাদার কোম্পানি গঠন সেটারই এক ধারাবাহিকতা।

সোবহানবাগে জুমশেপারের অফিসে বসে গত ২১ অক্টোবর কথা হচ্ছিল কাওসারের সঙ্গে। যোগাযোগের সময় কাওসার জানিয়েছিলেন, এ অফিসটা একটু ছোট। ‘আমরা আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে চলে যাচ্ছি।’ জুমশেপারের আগের অফিস ছিল ঢাকার লালমাটিয়ায়। এখন ভবনসহ নিজস্ব অফিস প্রাঙ্গণ নির্মিত হচ্ছে পূর্বাচলে। ‘ওলিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নতুন ক্যাম্পাসে গিয়ে আমরা ঘোষণা দেব।’

ওলিও মানে কী? ‘মানে খুঁজতে যাইনি। চার–পাঁচ অক্ষরের কোনো শব্দ দিয়ে ডটকম ডোমেইন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যখন দেখলাম ollyo.com ডোমেইন ফাঁকা আছে, তখনই এটা নিয়ে নিলাম। আমাদের চাওয়াটা ছিল কম অক্ষরের নাম এবং সঙ্গে অবশ্যই ডটকম থাকতে হবে।’

আগের অফিসে যেমন ছিল সৃজনশীল কাজের পরিবেশ, তেমনি সোবাহানবাগের বর্তমান অফিসের পরিবেশও তেমন। যদিও কাওসারের ভাষায়, ‘এটা ছোট।’ ছয়তলায় জুমশেপারের অফিসে ঢুকে বাঁয়ে চোখে পড়ল ভিডিও গেম খেলার যন্ত্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিডিও গেমের দোকানে আগে আর্কেড গেম খেলার যন্ত্র যেমন দেখা যেত। ‘আমরা বানিয়েছি। এটাতেও কয়েন ফেলে খেলা যায়। গেম চালানোর জন্য ছোট্ট র ্যাস্পবেরি কম্পিউটার রয়েছে এতে।’

ঢুকে বাঁ দিকে টেবিল টেনিস খেলার টেবিল। কাচঘেরা ছোট সভাকক্ষে বসে কাওসারের সঙ্গে যখন কথা চলছিল, একটা সময় পিং পং বল আর টেবিল টেনিস ব্যাটের খটখট আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে ১০–১২ জন দর্শকের আওয়াজ। আমাদের কথার মাঝখানে এল কফি। ‘কফিটা নিন, আমাদের কফি ভালো। মেশিনে নিজেরাই বানাই।’ দুপুরে কর্মীদের খাওয়ার সুবিধাও দেওয়া হয় জুমশেপারে। এই সময়ের রীতি অনুযায়ী এই অফিসও ওপেন অফিস। এমনকি কাওসারের বসার জায়গাটাও কর্মীদের সঙ্গে একটা ডেস্কে। সেদিকটায় ঢুঁ মেরে দেখা গেল প্রতিটি ডেস্কেই অ্যাপলের আইম্যাক কম্পিউটার। সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

একনজরে

জুমশেপার

প্রতিষ্ঠা

জুন, ২০১০

কর্মী

৭০ জনের বেশি

মূল কোম্পানি

ওলিও

খাত

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি

পণ্য

সফটওয়্যার

পণ্যের সংখ্যা

২০০–এর বেশি

এখন কী নিয়ে কাজ করছেন? বললেন, ‘টিউটর এলএমএস (লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম)। এটা আমাদের নতুন পণ্য।’ কাওসারের ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল, অনলাইনে যাঁরা পড়ান, কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে কিংবা টিউটরিয়াল করান, তাঁদের পুরো বিষয়টি ব্যবস্থাপনা করা যায় এই সফটওয়্যার দিয়ে। নানা রকম বিষয় এখন অনলাইনে পড়ানো হয়, তাই এ ধরনের সফটওয়্যারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিছুদিন আগে এটি অনলাইনে ছেড়েছে জুমশেপার। এটাও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য। কাওসার যোগ করেন, ‘আমাদের সব পণ্যই আন্তর্জাতিক ক্রেতাকে লক্ষ্য করে।’

এখানেই কাওসার আহমেদ ব্যতিক্রম। হাতে গোনা যে কটি দেশি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের পণ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, জুমশেপার তার একটি। ‘আমরা তথ্যপ্রযুক্তি সেবাভিত্তিক কাজ না করে সফটওয়্যার পণ্য বাজারে ছাড়ি। ফলে প্রতিযোগিতা করতে হয় বৈশ্বিক মাঠেই।’ এ পর্যন্ত জুমশেপারের ২৩০টি পণ্য ১ কোটিবারের বেশি নামানো (ডাউনলোড) হয়েছে। বাংলাদেশি কেন, বৈশ্বিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এ সংখ্যা উল্লেখ করার মতোই। সব কটিই গ্রাহক কিনে ব্যবহার করেন? ‘প্রথম এক মাস বিনা মূল্যে, এরপর প্রিমিয়াম সংস্করণ কিনে ব্যবহার করতে হয়। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গ্রাহক প্রিমিয়াম সংস্করণের গ্রাহক হয়ে থাকেন।’

কাওসার আহমেদের পড়াশোনার বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। তবে ছিল প্রযুক্তি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে নেন। বললেন, ‘বই পড়ে প্রোগ্রামিং শিখেছি। ২০০৮–৯–এ ফ্রিল্যান্সিং করতাম। ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ ছিল সেগুলো।’ এই অভিজ্ঞতা থেকে জুমশেপারের শুরু। একজন, দুজন করে দল বড় হয়ে উঠতে থাকল। ২০১২ সালে এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে জুমশেপারের অফিস নিলেন। এখন এ প্রতিষ্ঠানের কর্মিসংখ্যা ৭০। সফটওয়্যার প্রকৌশলী ৩০ জন, ১২ জন ডিজাইনার। বাকিরাও প্রযুক্তির নানা রকম কাজ করেন।

শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি দেখা হয় না কাওসারের প্রতিষ্ঠানে। দেখা হয় দক্ষতা। যেমনটি বলেন কাওসার, ‘আমাদের ডিজাইনাররা বিশ্ব মানের। লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন আর নিজের কাজে দক্ষ, তাঁদের আমরা নিয়োগ দিই। বেশ কিছু কর্মী আছেন, যাঁরা শুরু থেকেই রয়েছেন।’ কাওসারের নিজের বয়স মধ্যতিরিশের ঘরে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গড় বয়স ২৮ বছর। তারুণ্যনির্ভর তো বলাই যায়। নারী কর্মীর হার ৩০ শতাংশ।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় বাড়ি কাওসারের। বাবা আলী আকবর পেশায় ব্যবসায়ী, মা জাহেদা খাতুন গৃহিণী। কাওসাররা দুই ভাই, এক বোন। তাঁর নিজের পরিবারে আছেন স্ত্রী জিনিয়া আকতার এবং দুই মেয়ে জারা (৯) ও আরা (৪)। ধানমন্ডির বাসায় মা–বাবা আর নিজের পরিবার নিয়ে থাকেন কাওসার। কাজের অনুপ্রেরণাও পান তাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত।

সফটওয়্যার পণ্য তৈরির যে প্রক্রিয়া, সরাসরি সেই পথে হাঁটেন না কাওসার আহমেদ। ‘গ্রাফিক ডিজাইন আগে করি আমরা। তারপর প্রোগ্রামিং। ব্যবহারকারীর জন্য সুন্দর একটা ডিজাইন তৈরি করি। সেটাকে ফুটিয়ে তোলার পর করা হয় প্রকৌশলগত বিষয়গুলো। ওয়েবসাইট তৈরির সফটওয়্যার আর টুলস এমনভাবে তৈরি করা, যাতে যে কেউ ওয়েবসাইট তৈরি করতে পারে। “নো প্রোগ্রামিং ওয়েব টুল” এগুলো। যে কেউ প্রোগ্রামিং সংকেত না লিখেই বানাতে পারবেন ওয়েবসাইট।’ এ রকম কারণেই হয়তো কাওসার আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পেরেছেন। ‘আমরা এখন জুমলার টেমপ্লেট আর বানাই না। তবে বাজারে ছাড়া অনেকগুলোই আছে। ওয়ার্ডপ্রেসভিত্তিক কাজও চলছে।’ তাই ওলিওর অধীনে এ দুটি ভাগ থেকেই যাচ্ছে। কাওসার বলছিলেন, ‘জুমশেপার নামে মনে হয় আমরা শুধুই জুমলাভিত্তিক পণ্য তৈরি করি। নাম বদলানোর এটাও এক কারণ।’

কোম্পানি হিসেবে ভালো কর্মপরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করে জমুশেপার। মেয়েদের জন্য কাজের পরিবেশ ভালো, অফিস সংস্কৃতিতে কর্মীরা বেশ খুশি বলেই জানালেন কাওসার। পূর্বাচলে নতুন অফিস সম্পর্কে কাওসার জানালেন, এক বিঘা জমিতে ছয়তলার অফিস ভবন হবে। এখন যদিও চারতলা পর্যন্ত উঠবে ভবনটি। কর্মীদের যাতায়াতে থাকবে নিজস্ব পরিবহনসুবিধা। জিম থাকবে, খেলার জায়গাও থাকবে।

ইলন মাস্ক আর স্টিভ জবসকে আদর্শ মানেন কাওসার আহমেদ। ‘ইলন মাস্ক সত্যিকারে ভিশনারি। প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের স্বাভাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিতে চান বেশি করে। স্টিভ জবসের ডিজাইন, দর্শন আমাকে মুগ্ধ করে। ডিজাইন তিনি সবার আগে মাথায় রাখতেন।’ এ বিষয়ে কাওসার শুধু যে মুগ্ধ তা নয়, নিজের প্রতিষ্ঠানেও এর চর্চা করেন।’

এত কিছুর পরও কাওসারের আক্ষেপ—‘এখন পর্যন্ত এমন পণ্য তৈরি করতে পারিনি, যা লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে দেবে।’ তাই মানুষের জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে চান তিনি। আগামী ১০ বছরে এমন প্রযুক্তি পণ্য প্রস্তুতকারক হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানকে দেখতে চান কাওসার।

পল্লব মোহাইমেন: প্রথম আলোর যুগ্ম িফচার সম্পাদক