নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের উন্নয়নের নামে চাতুরী

৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প ৯২৭ কোটি টাকায় তোলার পর নাকচ।

প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রস্তাব চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কীভাবে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়, তা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। আবার কীভাবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে হয়, সেই কৌশলও পুরোপুরি কাজে লাগাতে জানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। কিন্তু কোনো কৌশলই এখন পর্যন্ত কাজে লাগেনি।
নাটোরে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে সারা বছর চিনি পরিশোধনের কথা বলে সাত বছর আগে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া একটি প্রকল্প মাঝপথে এসে বাতিল করে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এতে লোকসানি প্রতিষ্ঠানটি গভীর সংকটে পড়েছে।
জানা গেছে, ঘটনার শুরু ২০১৪ সালে। দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা উল্লেখ করে এবং সারা বছর চিনি পরিশোধনের পরিকল্পনা তুলে ধরে নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের নামে বিএসএফআইসি একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি যাতে দ্রুত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) পাস হয়, সে জন্য কৌশলে যন্ত্রপাতির দাম ধরা হয় কম করে। আর যন্ত্রপাতি আমদানির সিদ্ধান্ত হয় ভারত ও চীন থেকে। ৭৩ কোটি টাকা খরচে ‘নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সুগার রিফাইনারি স্থাপন’ শিরোনামের প্রকল্পটি দুই বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৬ সালে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফআইসি।

তিনবার দরপত্র আহ্বান করতে করতেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখন ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির কথা বলে প্রকল্পের ব্যয় ৭৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩২৪ কোটি টাকায় উন্নীত করে আবার একনেক সভায় অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়।

প্রকল্পটি অনুমোদনের পর পাল্টে যায় পরিকল্পনা। ভারত ও চীন থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার তুলনায় ইউরোপীয় যন্ত্রপাতির দাম অনেক বেশি হয়। ফলে পরপর তিনবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পায়নি বিএসএফআইসি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, দরপত্রে অংশ নিয়ে ঠিকাদার যে দর দিয়েছিল, অনুমোদিত প্রকল্পের ব্যয় ছিল তার চেয়ে অনেক কম। কারণ, অনুমোদিত প্রকল্পে যন্ত্রপাতি আমদানির কথা ছিল ভারত ও চীন থেকে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে দেখা যায়, তিনবার দরপত্র আহ্বান করতে করতেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখন ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির কথা বলে প্রকল্পের ব্যয় ৭৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩২৪ কোটি টাকায় উন্নীত করে আবার একনেক সভায় অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয় ২০১৮ পর্যন্ত। কিন্তু দুবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও সর্বনিম্ন দরদাতা ঠিক করতে পারেনি বিএসএফআইসি। কারণ, প্রতিবারই যেসব আন্তর্জাতিক দরপত্র পাওয়া গেছে, সবই ছিল এক হাজার কোটি টাকার ওপরে, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি।

নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের চিনি পরিশোধন প্রকল্পটি সাত বছর আগে নেওয়া হলেও এর অগ্রগতি সামান্য। তারা এই প্রকল্প অনুমোদনের আগে সমীক্ষাও করেনি। বিএসএফআইসি এই প্রকল্পের যে খরচ নিয়ে এসেছে, তা অস্বাভাবিক। আর নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রকল্পের খরচ অস্বাভাবিক হারে বাড়লে তা অনুমোদনের সুযোগ নেই।
নাসিমা বেগম, সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন

পাঁচবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও যখন কোনো ঠিকাদার পাওয়া যায়নি, তখন বিএসএফআইসি তৃতীয় দফায় প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ৩২৪ কোটি থেকে ৯২৭ কোটি টাকায় উন্নীত করে গত মাসে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। এবারের প্রস্তাবে খরচ বেড়েছে ৬০৩ কোটি টাকা বা ১৮৫ শতাংশ। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যয় দেখে প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখেই বাতিল করে দেয় পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে নতুনভাবে বিস্তারিত সমীক্ষার ভিত্তিতে পুনরায় প্রকল্পটি তৈরির পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নাসিমা বেগম বলেন, নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের চিনি পরিশোধন প্রকল্পটি সাত বছর আগে নেওয়া হলেও এর অগ্রগতি সামান্য। তারা এই প্রকল্প অনুমোদনের আগে সমীক্ষাও করেনি। বিএসএফআইসি এই প্রকল্পের যে খরচ নিয়ে এসেছে, তা অস্বাভাবিক। আর নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রকল্পের খরচ অস্বাভাবিক হারে বাড়লে তা অনুমোদনের সুযোগ নেই। নাসিমা বেগম আরও বলেন, এই প্রকল্প আর সামনে নেওয়ার সুযোগ নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি) প্রকল্পটি অনুমোদনের পক্ষে নয়। তাই সর্বসম্মতক্রমে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের এখন সমীক্ষা করে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে।

নাটোরের লালপুর উপজেলায় ১৯৩৩ সালে নর্থ বেঙ্গল চিনিকল স্থাপিত হয়। তখন চিনিকলটিতে দৈনিক আখমাড়াইয়ের ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ২২০ টন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সালে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে দৈনিক আখমাড়াইয়ের ক্ষমতা উন্নীত করা হয় দেড় হাজার টনে। চিনিকলটির অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই এখন জরাজীর্ণ।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নাটোরের লালপুর উপজেলায় সেই ১৯৩৩ সালে নর্থ বেঙ্গল চিনিকল স্থাপিত হয়। তখন চিনিকলটিতে দৈনিক আখমাড়াইয়ের ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ২২০ টন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সালে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করে দৈনিক আখমাড়াইয়ের ক্ষমতা উন্নীত করা হয় দেড় হাজার টনে। চিনিকলটির অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই এখন জরাজীর্ণ। ফলে আখমাড়াইয়ের ক্ষমতাও অনেক কমেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী নর্থ বেঙ্গল চিনিকল একটি লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দেয় ৯৫ কোটি টাকা। এই চিনিকলে কেজিপ্রতি চিনির গড় উৎপাদন খরচ সুদসহ দাঁড়ায় ১৩২ টাকা, আর সেই চিনি বিক্রি হয় ৫৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি চিনিতে ৭৬ টাকা লোকসান দিচ্ছে নর্থ বেঙ্গল চিনিকল। এমন বাস্তবতায় চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন এবং অ্যালকোহল, বিদ্যুৎ, জৈব-গ্যাস ও জৈব কম্পোস্ট উৎপাদনের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের কথা বলে ২০১৪ সালে প্রকল্প হাতে নেয় বিএসএফআইসি।

প্রথম যখন প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল, তখন প্রকল্পের ব্যয় সঠিকভাবে ধরা হয়নি। ওই সময় যন্ত্রপাতির দাম ধরা হয়েছিল ভারত ও চীনের বাজারের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু দরপত্র আহ্বান করা হয় ইউরোপের বাজার বিবেচনায়।
কবীর আহমেদ, প্রকল্প পরিচালক

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের ব্যয় ৩২৪ কোটি টাকায় তোলার পর থেকে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে কেনা হয়েছে একটি জিপ, ৫টি ট্যাংকলরি এবং একটি ডাবল কেবিন পিকআপ। প্রকল্পের অন্য কোনো কাজ না হওয়া সত্ত্বেও কেন যানবাহন কেনা হয়েছে এবং সেগুলো কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য কেনা জিপটি এখন বিএসএফআইসির সদর দপ্তরে ব্যবহৃত হচ্ছে, আর বাকি যানবাহন প্রকল্প এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক কবীর আহমেদ বলেন, বেশি দিন হয়নি আমি এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছি। নর্থ বেঙ্গল চিনিকলকে লাভজনক করতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রথম যখন প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল, তখন প্রকল্পের ব্যয় সঠিকভাবে ধরা হয়নি। ওই সময় যন্ত্রপাতির দাম ধরা হয়েছিল ভারত ও চীনের বাজারের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু দরপত্র আহ্বান করা হয় ইউরোপের বাজার বিবেচনায়। কবীর আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা এখন নতুনভাবে সমীক্ষা করে তারপর প্রকল্পটি প্রণয়ন করব।’