নিবন্ধন ছাড়া পর্যটন ব্যবসা নয়

এঁরা লেডি ট্র্যাভেলার্স অব সিলেটের সদস্য। পর্যটকদের সহায়তা করা তাঁদের কাজ। পর্যটন ব্যবসার জন্য এখন তাদের নিবন্ধন নিতে হবে।
প্রথম আলো

করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় ঘুরে বেড়ানো আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ধাক্কা কাটিয়ে পর্যটন ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই আবার দেশে শুরু হয়েছে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ বা সাধারণ ছুটি। কিন্তু পর্যটন কার্যক্রম পুরোদমে আবার শুরু হতে হতে অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে। কারণ, এ খাতে নতুন আইন আসছে।

জাতীয় সংসদে সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড (নিবন্ধন ও পরিচালনা) আইন, ২০২১’ বিল উত্থাপন করা হয়েছে। অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিলটি এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছে। সংসদে বিলটি পাস হলে দেশের সব ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে তিন মাসের মধ্যে নিবন্ধন নিতে হবে। আর তিন বছর পরপর নিবন্ধন নবায়ন করতে হবে। তবে কোন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ নিবন্ধন নিতে হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ খাতের ব্যবসায়ীরা অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) থেকে নিবন্ধন নিতে হতে পারে।

আইনটি পাস হলে নিবন্ধন ছাড়া কোনো ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারবে না। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক ট্যুর গ্রুপগুলো বেকায়দায় পড়বে।

আইনটি পাস হলে নিবন্ধন ছাড়া কোনো ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারবে না। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক ট্যুর গ্রুপগুলো বেকায়দায় পড়বে। ফলে আপনাকে কেবল নিবন্ধিত ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে কিংবা নিজস্ব ব্যবস্থায়ই ঘুরতে যেতে হবে।

বর্তমানে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সদস্যসংখ্যা ৭৮৬। এর বাইরে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা পর্যটন ব্যবসায়ে জড়িত। আইন হয়ে গেলে টোয়াব ও টোয়াবের বাইরের সব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও নিবন্ধন নিয়ে তবেই ব্যবসা করতে হবে। এ ছাড়া সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে অ্যাগোডা, বুকিংডটকমসহ বিশ্বখ্যাত অপারেটরদেরও নিবন্ধন নিয়ে এ দেশে ব্যবসা করতে পারবে।

দেশের গণমাধ্যম, টেলিভিশন, বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশ-বিদেশে ঘোরার নানা ধরনের প্যাকেজ অফার করা হয়। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শত শত ট্যুর অপারেটর ও গাইডের পেজ আছে। এসব গ্রুপ টাকার বিনিময়ে দেশের দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা করে থাকে। প্রায় প্রতি মাসেই নানা ধরনের ট্যুরের আয়োজন করে। দেশের তরুণ-তরুণীদের কাছে এসব গ্রুপ বেশি জনপ্রিয়। কারণ, ফেসবুক পেজগুলোয় দেশের পর্যটন স্পটগুলোর ছবি থাকে। ফেসবুকভিত্তিক এসব ট্যুর অপারেটর ও গাইডেরও নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক। তা না হলে বিপাকে পড়তে হবে।
কোনো ট্যুর অপারেটর বা গাইড নিবন্ধন না নিলে জেল-জরিমানার মুখে পড়তে হবে। নতুন আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন না নিলে অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড এবং অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে টোয়াবের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই সব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন হোক। তাহলে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। তবে বিদেশি ট্যুর অপারেটরদের এ দেশে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে দেশি অপারেটররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অ্যাগোডা, বুকিংডটকমের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিদেশি পর্যটকেরা ওই সব নামজাদা প্রতিষ্ঠানের সেবাই নেবে।’

মো. রাফেউজ্জামানের মতে, করোনার কারণে এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ যাচ্ছে; দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন এই ব্যবসার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেবে।
টোয়াব সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে বছরে প্রায় এক কোটি পর্যটক দর্শনীয় স্থানগুলোয় ভ্রমণ করেন। বিদেশে ঘুরতে যাওয়া ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশ ট্যুর অপারেটরদের প্যাকেজ নিয়ে যান। বিদেশিরা যাঁরা এ দেশে ঘুরতে আসেন, তাঁদের প্রায় শতভাগই দেশীয় ট্যুর অপারেটরদের সহায়তা নেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ট্যুর অপারেটররা ২ হাজার ৫২২ কোটি টাকার ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করেছে।

বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ

স্থানীয় ট্যুর অপারেটর ও গাইডদের আয়োজিত কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের ট্যুরগুলো বেশি জনপ্রিয়। এ ছাড়া রাজধানীর আশপাশে দিনব্যাপী প্যাকেজও আছে। দেশের বাইরে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া—এসব দেশ ভ্রমণের প্যাকেজগুলো ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। সাধারণত ট্যুর অপারেটরদের প্যাকেজের আওতায় যাতায়াত, হোটেলভাড়া ও খাবারের খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে। সঙ্গে একজন ট্যুর গাইডও দেয় তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ট্যুর অপারেটররা ২ হাজার ৫২২ কোটি টাকার ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করেছে। এসব প্যাকেজে যাতায়াত, হোটেল, খাবারসহ বিভিন্ন সেবা কিনতে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। বাকি ১৮১ কোটি টাকা পেয়েছে ট্যুর অপারেটররা।
বিবিএস বলছে, ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রতিবছর গড়ে ২২০ কোটি টাকা যোগ করছে। প্রতিবছরই এর পরিমাণ বাড়ছে।

ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে। বিবিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫২০টি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে ট্যুর ব্যবস্থাপক, হিসাবরক্ষক, গাইডসহ সব মিলিয়ে ২ হাজার ৬৪৩ জন কাজ করেন। তাঁদের মাসিক বেতন গড়ে ১৪ হাজার ৫০৫ টাকা। বেতন-ভাতা বাবদ এক বছরে খরচ ৪৫ কোটি টাকা।