পুঁজিবাজারে থাকা ৬২টি মার্চেন্ট ব্যাংকের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কাজ করছে না। ৭টি আছে পরিশোধিত মূলধনের ঘাটতিতে। মূলধন ঘাটতিসহ লাইসেন্সের নানা ধরনের শর্ত মানছে না ৩০টি মার্চেন্ট ব্যাংক। এদের বিরুদ্ধে আবার ততটা কঠোরও নয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
পুলসংখ্যক মার্চেন্ট ব্যাংক অস্তিত্বসংকটে থাকার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নতুন করে আরও ২৫টি মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে চায়।
মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স এযাবৎ বিএসইসি নিজেই দিয়ে আসছিল। কিন্তু এ দফায় লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে বিএসইসি। সে আলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবে বলে জানা গেছে। এখন অর্থমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে তিনি আর কতটি লাইসেন্স দিতে চান বা আদৌ দিতে চান কি না।
মার্চেন্ট ব্যাংক পুঁজিবাজারে নতুন ইস্যু আনা ও পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এবং আন্ডাররাইটিংসহ বেশ কিছু কাজ করে। অন্য কাজের মধ্যে রয়েছে করপোরেট পরামর্শ দেওয়া, ঋণ সিন্ডিকেশন করা, চলতি মূলধনের অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, বিল ডিসকাউন্ট করা, ইজারা অর্থায়নের ব্যবস্থা করা, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তবে মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান কাজ বিবেচনা করা হয় নতুন কোনো কোম্পানিকে বাজারে আনা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ১৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশের সব মার্চেন্ট ব্যাংকের সর্বশেষ চিত্র বিশ্লেষণ করেছে। এর মধ্যে ৩টি আংশিক অর্থাৎ ইস্যু ম্যানেজারের কাজের জন্য লাইসেন্স নেওয়া। একটি লাইসেন্স নিয়েছে শুধু পোর্টফোলিও ম্যানেজারের কাজ করবে বলে। বাকি ৫৮টি মার্চেন্ট ব্যাংক ফুল ফ্লেজের অর্থাৎ ইস্যু ম্যানেজার, পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এবং আন্ডাররাইটিং—সব কাজই করবে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ২০১২ সালে মার্চেন্ট ব্যাংক ৬৫ টি পর্যন্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ সর্বশেষ লাইসেন্স পায় ইসলামী ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। আরেকটিকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য গত মাসে কমিশন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর নাম ইউসিবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৮টি ব্যাংক, ৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ১৮টি অন্যান্য মিলিয়ে ৩৪টি মার্চেন্ট ব্যাংকের আবেদন জমা আছে। সাধারণত দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে থাকে। কেউ কেউ রাজনৈতিক বিবেচনায়ও এ লাইসেন্স পায়।
ব্যক্তিবিশেষকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে—এমন কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে এখন পরিশোধিত মূলধনের ঘাটতিতে। অর্থাৎ অর্থের অভাবে ভালো ব্যবসা করতে পারছেন না তাঁরা।
কেন নতুন লাইসেন্স—এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় অর্ধেক যেহেতু বন্ধ, তাই আমরা নতুন করে ২৫টিকে লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি নিয়ে রাখতে চাইছি। এগুলো দেওয়া হবে মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।’লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন করা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। এটাও চিন্তা করছি।’
মূলধন ঘাটতিতে ৭ মার্চেন্ট ব্যাংক
বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, ৭টি মার্চেন্ট ব্যাংক পরিশোধিত মূলধনেই ঘাটতি রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২০১২ সালে লাইসেন্স পাওয়া বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
বিদ্যমান সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার) বিধিমালা, ১৯৯৬ অনুযায়ী বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্টের ২৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকার কথা। বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্টের আছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ কোটি টাকাই ঘাটতি।
এটিসহ প্রতিষ্ঠানটি মোট তিনটি ধারা লঙ্ঘন করেছে। বিধির ৩৭(১) ধারা অনুযায়ী বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে পর্ষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দেবে। সিইও অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি। ১১ ধারা অনুযায়ী বিএসইসিতে হিসাবপত্র দাখিলের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাও পরিপালন করেনি এই মার্চেন্ট ব্যাংক।
একইভাবে কসমোপলিটন ফাইন্যান্স ১৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এই মার্চেন্ট ব্যাংকও বেঙ্গলের মতোই তিনটি ধারা লঙ্ঘন করেছে।
এ ছাড়া সিএপিএম অ্যাডভাইজারি লিমিটেড ১৫ কোটি, সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ৯ কোটি ৬৪ লাখ, রেস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট ৫ কোটি এবং পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্টস ৮৫ লাখ টাকার ঘাটতিতে রয়েছে।
এ ছাড়া ৮টি মার্চেন্ট ব্যাংক সিইও নিয়োগে বিএসইসির অনুমোদন নেওয়া বিষয়ক শর্ত পরিপালন করেনি বলে জানা গেছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বাজারে কোম্পানি আনার কাজ করতে হয়, যা থেকে আয় হয় তাদের। কিন্তু নতুন কোম্পানি বাজারে আসার বাস্তবতা শুধু মার্চেন্ট ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে না। এটা একান্তই নীতি-সিদ্ধান্ত ও নীতি-সহায়তার বিষয়। হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দিলে হবে না। অন্য সব নীতি পুঁজিবাজারবান্ধব না হলে শুধু মার্চেন্ট ব্যাংকের ওপর দায় চাপানো ঠিক হবে না।
১১ ধারার লঙ্ঘন ২১টির
মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার ১১টি শর্তের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ১১ নম্বরটি। ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে প্রতিটি ফুল ফ্লেজের মার্চেন্ট ব্যাংককে দুই ইংরেজি পঞ্জিকা বছরে কমপক্ষে একটি কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনার প্রস্তাব বিএসইসিতে দাখিল করার কথা বলা আছে। এ ছাড়া পোর্টফোলিও ম্যানেজার হিসেবে প্রতিবছরে নিজস্ব পোর্টফোলিওর অতিরিক্ত কমপক্ষে পাঁচটি নতুন মক্কেলের পোর্টফোলিও গঠন করবে।
বিএসইসি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে, ২১টি মার্চেন্ট ব্যাংক এ শর্ত লঙ্ঘন করেছে। এগুলো হচ্ছে বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট, কসমোপলিটন ফাইন্যান্স, এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্ট, রেস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট, এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স ইনভেস্টমেন্ট, বেটা ওয়ান ইনভেস্টমেন্টস, ইসি সিকিউরিটিজ, এক্সিম ইসলামি ইনভেস্টমেন্ট, গ্রিন ডেলটা ক্যাপিটাল, হাল ক্যাপিটাল, আইএল ক্যাপিটাল, যমুনা ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, মাইডাস ইনভেস্টমেন্ট, রিভারস্টোন ক্যাপিটাল, সোনালী ইনভেস্টমেন্ট, ট্রাস্ট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্চেন্ট ব্যাংক যত বাড়বে, বাজারে তারল্য তত বাড়বে। সে হিসেবে নতুন লাইসেন্সের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।’
তবে পিছিয়ে থাকা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে কার্যকর করার নীতি গ্রহণ করতে হবে বলেও মনে করেন বিএমবিএর সভাপতি। তিনি বলেন, ব্যাংকের সহযোগী যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক, তারা জামানত ছাড়াই ঋণ পায়। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তা পায় না। এ ব্যবস্থা করতে হবে। আবার মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর কথাও বিএসইসি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে পারে।