পাদুকা ব্যবসায়ীদের নজর এখন অভ্যন্তরীণ বাজারে

চামড়াজাত পণ্য বিদেশে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তার অন্যতম পাদুকা।
চামড়াজাত পণ্য বিদেশে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তার অন্যতম পাদুকা।

দেশের যে কয়টি চামড়াজাত পণ্য বিদেশে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তার অন্যতম পাদুকা। প্রতিবছরই পাদুকা রপ্তানি থেকে আয় বাড়ছে। দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানই বিশ্বখ্যাত জুতা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য জুতা তৈরি করছে।
রপ্তানিকে কেন্দ্র করেই এত দিন দেশীয় পাদুকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা বাড়ালেও এখন ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ বিশাল বাজার ধরার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। আর সেদিকটি মাথায় রেখে দেশে নিজেদের ব্যবসাও বাড়াচ্ছে তারা।
দেশে প্রতিবছর কত জোড়া পাদুকা বিক্রি হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ১৬ কোটি জোড়া পাদুকা (জুতা, সেন্ডেল, চপ্পল ইত্যাদি) বিক্রি হয়। আর পাদুকার স্থানীয় বাজার বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার।
কয়েক বছর আগেও বহুজাতিক কোম্পানি বাটাই ছিল স্থানীয় বাজারে পাদুকা সরবরাহকারী বড় প্রতিষ্ঠান। এরপর জায়গা করে নেয় এপেক্স। রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের একটি বড় অংশ দখল করে এই প্রতিষ্ঠানটি। এপেক্স এখন বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
পাদুকা প্রস্তুতকারী আরও কিছু প্রতিষ্ঠান দেশীয় ক্রেতাদের চাহিদা ও পছন্দের দিকে লক্ষ রেখে পাদুকা বাজারজাত করছে।
উৎপাদিত পাদুকা বিক্রির জন্য সারা দেশে ৫৫টি শোরুম আছে জেনিস শুজ লিমিটেডের। গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির নতুন ১০টি শোরুম উদ্বোধন করা হয়েছে।
জেনিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় দেশের পাদুকার বাজার ততটা বাড়েনি। এটি অনেকাংশেই বাটার দখলে ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি রুচিসম্মত পাদুকা কিনছেন। সব মিলিয়ে দেশের বাজারে পাদুকায় ভালো করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সে কারণেই আমরা ব্যবসা বাড়াচ্ছি।’
আগামী এক বছরে আরও ১০ থেকে ১৫টি শোরুম করার পরিকল্পনা রয়েছে জেনিসের। নাসির খান জানালেন, প্রতিটি শোরুম করতে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে তাঁদের। এসব শোরুমে সরাসরি পাঁচ থেকে ছয়জনের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আর পাদুকা তৈরি, বক্স তৈরিসহ পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে আরও অন্তত ৪০ জনের।
এর বাইরে কানাডার ব্র্যান্ড অ্যালডো এবং জাপানের এবিসি মার্টের মতো ব্র্যান্ডের জন্য পাদুকা প্রস্তুত করে জেনিস। সেসব পাদুকা অবশ্য রপ্তানি হয়।
বিশ্ববাজারে পাদুকার সম্ভাবনা দেখে ব্যাটারির জন্য বিখ্যাত হ্যামকো গ্রুপ বছর তিনেক আগে প্রতিষ্ঠা করে হ্যামকো লেদারস। সেখানে প্রস্তুত হওয়া পাদুকা এত দিন রপ্তানি হয়ে এলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশীয় বাজারে মনোযোগী হয়েছে। চলতি বছরের রমজানে রাজধানীর ফার্মগেটে প্রথম শোরুম উদ্বোধন করে হ্যামকো। এরই মধ্যে ঢাকায় আরও তিনটি এবং রাজশাহী ও জামালপুরে একটি করে শোরুম খুলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
হ্যামকো লেদারসের বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী এক বছরে আমরা সারা দেশে ৪০ থেকে ৫০টি শোরুম করার পরিকল্পনা করছি।’ তিনি জানান, একটি বড় শোরুম করতে প্রায় এক কোটি আর ছোট শোরুম করতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে তাঁদের। প্রতিটি শোরুমে চার থেকে পাঁচজনের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
২০০৬ সালে দেশের বাজারে পাদুকা ব্যবসা শুরু করে বে এম্পোরিয়াম। সারা দেশে এখন প্রতিষ্ঠানটির শোরুম আছে ৫০টি। কেবল গত এক বছরেই নতুন শোরুম হয়েছে ১০টি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আবদুল কাদের প্রথম আলোকে জানান, এখন থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটা এবং ২০১৫ সালে আরও ১০টা শোরুম খোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। আর ২০১৭ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি শোরুম খোলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বে এম্পোরিয়াম।
কাদের আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি এবং তাদের বেশির ভাগই ভালো মানের চামড়ার পাদুকা পছন্দ করেন। সে লক্ষ্যেই আমরা ব্যবসা বাড়াচ্ছি, ভালো ফলও পেয়েছি।’
রিগ্যাল, বিডটজেডডট মোডা এবং হিউম্যানিকের মতো ব্র্যান্ডের জন্য জুতা প্রস্তুত করে লেদারেক্স ফুটওয়্যার। রপ্তানিকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিচালনা করায় দেশে মাত্র চারটি শোরুম আছে প্রতিষ্ঠানটির। সব কটিই ঢাকায়। তবে দেশের ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী শিগগিরই ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
লেদারেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাজারে পাদুকার চাহিদা, পছন্দ একরকম। আবার রপ্তানি হওয়া পাদুকার চাহিদা, পছন্দ আরেক রকম। সে কারণে দেশের বাজার ধরতে হলে স্থানীয় চাহিদা মাথায় রেখেই পাদুকা প্রস্তুত করতে হবে। শিগগিরই আমরা এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আলাদা একটি উৎপাদন ইউনিট করার পরিকল্পনা করছি।’
পাদুকা প্রস্তুতকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেখানে বাজার সম্প্রসারণ করছে, সেখানে খানিকটা পিছু হটেছে দেশের বাজারে চার বছর আগে খুচরা পর্যায়ে পাদুকা বিক্রি শুরু করা ব্র্যান্ড ফরচুনা। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির এখন ২০টি শোরুম আছে। গত এক বছরে নতুন কোনো শোরুম হয়নি, উল্টো বন্ধ হয়ে গেছে চারটি শোরুম। এমন তথ্যই জানিয়েছেন ফরচুনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তাহের।
আবু তাহের বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে পাদুকার বাজার খুবই সম্ভাবনাময়। প্রতিবছরই বাজার বাড়ছে। কিন্তু খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় লোকসানি চারটি শোরুম বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’ আগামী কয়েক বছরে পাদুকা রপ্তানি থেকেই দুই থেকে তিন হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি ট্যানারিমালিক ও পাদুকাশিেল্পর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানান।