পানামা–কাণ্ডের পরেও অর্থ পাচারে পিতা–পুত্র

বাংলা ট্র্যাকের প্রতিষ্ঠানসমূহ


সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল নতুন বা ভাড়া যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে। অথচ আমদানি করা হয়েছে পুরোনো যন্ত্রপাতি। সেই যন্ত্রপাতি দিয়েই চলছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার এসব যন্ত্রপাতি কেনা হয় দুবাই ও সিঙ্গাপুরের দুই প্রতিষ্ঠান থেকে, যার মালিক তাঁর এক ছেলে। এভাবেই অর্থ পাচার করেছে বাংলা ট্র্যাক গ্রুপ।

এর আগে ২০১৬ সালে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারকারী ও কর ফাঁকি দেওয়া ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা পানামা পেপারসে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতেও পিতা, দুই পুত্র ও বাংলা ট্র্যাকের নাম ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে তারা নতুন করে অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়েছে।

বাংলা ট্র্যাক গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক। তাঁর দুই পুত্র হলেন তারেক ইকরামুল হক ও নাজিম আসাদুল হক। এর মধ্যে আমিনুল হক প্রাইম ফাইন্যান্সের পরিচালক ও তারেক ইকরামুল হক প্রাইম ব্যাংকের পরিচালক। তারা সবাই দেশের বাইরে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পরিচালিত বিশেষ এক পরিদর্শনে নিজেদের বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরোনো যন্ত্রপাতি কেনার মাধ্যমে অর্থ পাচারের এ তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। দুদকও প্রস্তুতি শুরু করেছে।

দেশীয় ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে বাংলা ট্র্যাকের প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আদালতের আদেশে ‘খেলাপিমুক্ত’ থেকে নতুন করে ঋণও নিয়েছে বাংলা ট্র্যাক। বাংলা ট্র্যাক গ্রুপ ২০০৪ সাল থেকে জ্বালানি, বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ ও ভাড়া, টেলিযোগাযোগ, খাদ্যপণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

পুরোনো যন্ত্রপাতি আমদানি

উচ্চ গতির ডিজেলচালিত ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলা ট্র্যাকের সঙ্গে চুক্তি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। ২০১৭ সালে আগস্টে হওয়া এ চুক্তির মেয়াদ ৫ বছর। চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল, কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এ কেন্দ্র নির্মাণ হবে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি হবে নতুন বা ভাড়ায় চালিত। চুক্তির পর বাংলা ট্র্যাক পাওয়ার ইউনিট-১ নামে কোম্পানি গঠন করে। যার ৫১ শতাংশ শেয়ার আমিনুল হকের, তিনি বাংলা ট্র্যাকের প্রতিনিধি। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার তাঁর ছেলে তারেক ইকরামুল হকের, তিনি অ্যাকর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস ও বাংলা ট্র্যাক কমিউনিকেশনের মনোনীত প্রতিনিধি।

প্রতিষ্ঠানটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দাউদ মেশিনারিজ এলএলসি থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলে। মূলত বিভিন্ন দেশ থেকে পুরোনো যন্ত্রপাতি আনার জন্য ঋণপত্র খোলা হয়। বিএফআইইউ প্রতিবেদনে বলেছে, বিদেশে অর্থ পাচারের জন্য নতুন যন্ত্রপাতির বদলে পুরোনো যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। পুরোনো যন্ত্রপাতির মূল্য যাচাই করা প্রায় অসম্ভব। আবার প্রকল্পটি পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে নির্মাণ করায় যেকোনো সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ হয়ে যাবে। সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির আয়ও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো।

দুবাই ও সিঙ্গাপুরের কোম্পানি

বাংলা ট্র্যাককে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা দাউদ মেশিনারিজ সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিবন্ধিত কোম্পানি। নথিপত্রেও এর মালিকানায় রয়েছে নাজিম আসাদুল হক। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কেটারপিলারের প্রস্তুতকৃত ১৫৪ সেট ডিজেল জেনারেটর আমদানি করে বাংলা ট্র্যাক। কেটারপিলারের একমাত্র আমদানিকারক বাংলাদেশের বাংলা ট্র্যাক। অথচ তারা সেই পণ্য এনেছে দাউদ মেশিনারিজের কাছ থেকে। ফলে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে পিতা ও ভাইয়ের কোম্পানির সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়েছে বলে বিএফআইইউ উল্লেখ করেছে।

তারেক ইকরামুল হক

বিএফআইইউ বলছে, দাউদ মেশিনারিজ মূলত সেল কোম্পানি। কর ফাঁকি দিতেই এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকে দাউদ মেশিনারিজের নামে ঋণপত্র খোলা হলেও প্রকৃত মালামাল সরবরাহ করেছে সিঙ্গাপুরের শ্যামল মেশিনারিজ ট্রেডিং পিটিই। নথিপত্রে এর মালিকও নাজিম আসাদুল হক। পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে বাংলা ট্র্যাক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড নামের আরও একটি কোম্পানি রয়েছে, যার পরিচালক দুই ভাই তারেক ইকরামুল হক ও নাজিম আসাদুল হক। ফলে বাংলা ট্র্যাক যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে, তা নিজেদেরই। এর মাধ্যমে গ্রুপটি অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ বা কোনো সম্পদ বাইরে নিয়ে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। শুধু ভ্রমণ, চিকিৎসা খরচ বাবদ নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ বাইরে নেওয়ার বিধান রয়েছে। এরপরও বাংলা ট্র্যাক বিদেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিট সম্পদ এত বেশি হয়েছে যে বিদেশে বাংলা ট্র্যাকের এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৫ কোটি ডলার বা ৪২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে দুবাইয়ের মাশরেক ব্যাংক। এই ঋণের করপোরেট জামিনদার আবার বাংলা ট্র্যাক ও তারেক ইকরামুল হক। আমদানি দায় পরিশোধে দফায় দফায় সময় বাড়ানোর পর বিদেশি এই ঋণের ব্যবস্থা করে গ্রুপটি। বিএফআইইউ বলছে, এই ঋণের মাধ্যমে প্রমাণ হয়, বিদেশে তাদের ঋণের চেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে।

বাংলা ট্র্যাকের বক্তব্য

বিদেশে কোম্পানি থাকা, পুরোনো যন্ত্রপাতি আমদানি, ঋণ খেলাপির পরও ঋণ নিয়ে বাংলা ট্র্যাকের কাছে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি নির্দিষ্ট ধরনের ইঞ্জিনই দরকার ছিল এবং ওই কাজে বাজারে শুধু ব্যবহৃত ইঞ্জিনই পাওয়া যায়। এটি এই খাতে স্বীকৃত একটি প্রক্রিয়া, যা অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও অনুসরণ করে। ইঞ্জিন ক্রয় প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকারের সব সংশ্লিষ্ট দপ্তর উল্লিখিত ইঞ্জিনগুলোর উৎস এবং এর মূল্যের পাশাপাশি এই পূর্ব ব্যবহৃত বিষয়টি সম্পর্কেও অবহিত ছিল। অতএব ঋণপত্র খোলার জন্য এবং আর্থিক সহায়তার জন্য ব্যাংকের সাহায্য নেওয়া থেকে শুরু করে ব্যবহৃত ইঞ্জিনের ধরন, এর মূল্য, ক্রয় উৎস এবং আমদানির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার ওপর ব্যাংকঋণ এবং ঋণ পরিশোধ নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই।

আরও বলা হয়, এই প্রক্রিয়ার সবকিছু বাংলাদেশের আইন মেনেই করা হয়েছে এবং এই কথিত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তার বেশির ভাগ তথ্য অসত্য ও ভুল। বাংলা ট্র্যাক সব সময়ই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আমরা সব সময় স্থানীয় আইন ও নীতিমালা মেনে চলি।

নাজিম আসাদুল হক

দেশে খেলাপি, এরপরও নতুন ঋণ

বাংলা ট্র্যাককে দেশের কয়েকটি ব্যাংক মিলে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৮ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭২৬ কোটি টাকার ঋণ ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।

জানা গেছে, বাংলা ট্র্যাক আদালতের মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করছে। আবার সেই সুবিধা নিয়ে নতুন করে ঋণও নিয়েছে। আদালতের মাধ্যমে খেলাপিমুক্ত থাকায় ঋণ দিতে রাজি হয়নি সোনালী, ডাচ্‌–বাংলাসহ কয়েকটি ব্যাংক। তবে ঋণ দিয়েছে সিটি ব্যাংক, রূপালী, এনআরবি কমার্শিয়াল, শাহ্‌জালাল ইসলামী, আর্থিক আইডিএলসি ও বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল) ।

যোগাযোগ করা হলে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুতের মালামাল এসেছে, তা বাংলা ট্র্যাকের না। আমরা নিশ্চিত হয়েই ঋণপত্র খুলেছি। পণ্যের দামও সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান যাচাই করেছে। ফলে অর্থ পাচারের কোনো সম্ভাবনায় নেই।

ঋণ খেলাপির বিষয়ে তিনি বলেন, মূলত প্রাইম ফাইন্যান্স ঋণ খেলাপি। তারা পরিচালনা পর্ষদে থাকায় খেলাপির মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের নিজেদের কোনো ঋণ খেলাপি নাই। আমরা যাচাই করেই গ্রুপটিকে অর্থায়ন করেছি।

জানতে চাইলে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সিন্ডিকেট ঋণে অংশ নিয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি ঋণের ব্যবস্থা করেছে, আমাদের দায়ও শোধ করে দিয়েছে।’

পানামা পেপারসে পুরো পরিবার

২০১৬ সালের পানামা পেপারসের মাধ্যমে ফাঁস হয় বিশ্বের ধনী লোকজন কীভাবে অফশোর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে কর ফাঁকি দেয়। বিদেশে গড়ে তুলে নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতেও এই পরিবারটির নাম এসেছিল। বাংলা ট্র্যাকের পাশাপাশি আমিনুল হক, তারেক ইকরামুল হক ও নাজিম আসাদুল হকের নাম ছিল ওই পেপারসে। বিএফআইইউ বলছে, পানামা পেপারসের ফাঁস হওয়া আগের ঘটনায় জানা না গেলেও সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রমাণ মিলেছে তারা সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। ঢাকার বনানীতে বাংলা ট্র্যাকের প্রধান কার্যালয়।