প্রতিশ্রুতি ছয়, বাস্তবায়ন দুই

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও জমি অধিগ্রহণের জটিলতাসহ নানা কারণে সময়মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।

দেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প খাতের উন্নয়নে গত এক দশকে ছয়টি বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবই বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প নগর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এত দিনে প্রধানমন্ত্রীর ওই সব প্রতিশ্রুতির মধ্যে মাত্র দুটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিগুলোর কোনো কোনোটির মূল কাজ শুরু হয়নি, কোনোটির জমি অধিগ্রহণ হয়েছে মাত্র, আর কোনোটির প্রকল্পই পাস হয়নি এখনো। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক প্রতিবেদনে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

বিসিক মূলত দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্পনগরী নির্মাণ করে প্লট বরাদ্দ দেয়, যাতে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উদ্যোক্তারা কলকারখানা গড়ে তুলতে পারেন। এ ছাড়া সরকারি সংস্থাটি নানা ধরনের বাণিজ্য অবকাঠামো এবং সুবিধাও নির্মাণ করে দেয়।

বিসিকের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার এ যাত্রায় প্রথম ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের মে মাসে বরগুনায় বিসিক শিল্পনগর স্থাপনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শন ও উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী একে একে আরও পাঁচটি বিসিক শিল্পনগর ও শিল্প পার্ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এগুলো হচ্ছে টাঙ্গাইল শিল্প পার্ক, সন্দ্বীপ বিসিক শিল্পনগর, সিরাজগঞ্জ শিল্প পার্ক, বরগুনা বিসিক শিল্পনগর এবং ঠাকুরগাঁও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল। এ ছাড়া রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার সাড়ে ১০ বছর পর ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বরগুনা বিসিক শিল্পনগরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নকাজ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ১০ বছর পর গত মাসে শেষ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পরও কেন বিসিকের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়, জানতে চাইলে বিসিকের পরিচালক (প্রকৌশল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন) মোহাম্মদ আতাউর রহমান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিসিকের প্রকল্প বাস্তবায়নে মোটাদাগে তিনটি সমস্যা আছে। প্রথমত, জমি অধিগ্রহণের জটিল প্রক্রিয়া, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা থাকে। এসব জটিলতা কাটিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে প্রকল্পের মেয়াদকালের বড় একটা সময় চলে যায়। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প পরিচালকদের দক্ষতার ঘাটতি। তৃতীয়ত, করোনার কারণে দুই বছর ধরে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাঙ্ক্ষিত অর্থ বরাদ্দ মিলছে না।

এবার দেখা যাক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া চলমান প্রকল্পগুলোর কী অবস্থা।

মাটির খোঁজেই গলদঘর্ম

২০১২ সালের ৩০ জুন টাঙ্গাইল শিল্প পার্ক স্থাপনের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর। তিন বছর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৯৬ কোটি টাকা। জানা গেছে, প্রকল্পটির প্রায় ৫০ একর জমিতে মাটি ভরাটের কাজ এখন শেষের দিকে। এই প্রকল্পে দেরি হওয়ার মূল কারণ হলো জমি ভরাটের জন্য যথাসময়ে পর্যাপ্ত মাটির সন্ধান মেলেনি। এটিই প্রকল্পটির বড় চ্যালেঞ্জ। তাই মাটি ভরাটের কাজ ঢিমেতালে চলেছে। যেমন কেউ মাটি বিক্রি করলে সেখান থেকে মাটি কিনে প্রকল্প এলাকা ভরাট করতে হয়েছে। আবার বর্ষায় কারও জমি পলি জমে উঁচু হয়ে গেলে সেই মাটি এনে এই প্রকল্পের জমি ভরাট করা হয়েছে। এভাবেই কেটে গেছে সাড়ে ছয় বছর। তবু আশার কথা, আগামী জুন মাসে টাঙ্গাইল শিল্প পার্কটি পুরোপুরি প্রস্তুত হবে। সেখানে উদ্যোক্তাদের ২৭১টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে।

কচ্ছপগতিতে দুই প্রকল্পের কাজ

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় আট বছর পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে বিসিক শিল্পনগর স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রস্তাবটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) বৈঠক করে। তবে বিসিকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ওপর প্রকাশিত বইয়ের সবুজ পাতায় বরাদ্দহীন অননুমোদিত প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে ঠাকুরগাঁও জেলায় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। খরচ ধরা হয় ১০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন মাসে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা।

সিরাজগঞ্জে ৫৭০টি প্লট প্রস্তুত হচ্ছে

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজগঞ্জকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা এবং সিরাজগঞ্জ শিল্প পার্ক স্থাপনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১১ বছর পর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এ জন্য ৭১৯ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে। সিরাজগঞ্জ সদরে ৪০০ একর জমির ওপর অবস্থিত শিল্প পার্কের কাজ শেষ হবে আগামী জুন মাসে। এতে ৫৭০টি প্লট তৈরি করা হচ্ছে।

বর্তমানে সারা দেশে বিসিকের অধীনে মোট ৭৯টি শিল্পনগর আছে। এসব শিল্পনগরে মোট জমির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার একর। ১০ হাজারের বেশি শিল্প প্লটে কারখানা আছে ৫ হাজার ৮৮৫টি। অনেক উদ্যোক্তা একাধিক প্লট নিয়ে একটি কারখানা করেছে। যা-ই হোক, এখনো খালি আছে পাঁচ শতাধিক প্লট।