প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলতেন ‘মুহিত সাহেব’

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কেমন আছেন তা জানতে গত ২১ মার্চ তাঁর ঢাকার বনানীর বাসায় যান প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সঙ্গে ছিলেন বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম। এ সময় আলাপে উঠে আসে সাবেক অর্থমন্ত্রীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের নানা দিক:

আবুল মাল আবদুল মুহিত
ছবি: সাজিদ হোসেন

শৈশব থেকেই আবুল মাল আবদুল মুহিত মেধার পরিচয় দিয়েছেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই। বাংলাদেশ যে আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাচ্ছে, তারও কারিগরদের অন্যতম তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০ বছর বাজেট উপস্থাপন করেছেন জাতীয় সংসদে। তাঁর সময়ে বড় হয়েছে বাজেটের আকার। আশির দশকের শুরুতে একবার অর্থমন্ত্রীর পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়ার উদাহরণও তৈরি করেন তিনি।

কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি—উভয় জায়গাতেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ তাঁর। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে জীবনভর ভালোবেসে যুক্ত থেকেছেন, ক্রীড়াঙ্গনকেও দিয়ে গেছেন পৃষ্ঠপোষকতা। খোলা মাঠে সারা রাত জেগে উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতেও দেখা গেছে তাঁকে। অথচ তখন তিনি দেশের ব্যস্ততম অর্থমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আমাকে কোনো দিন নাম ধরে ডাকেননি। সবচেয়ে বেশি বলতেন, “মুহিত সাহেব”। কখনো বলতেন, আওয়ারস ফাইন্যান্স মিনিস্টার (আমাদের অর্থমন্ত্রী)
আবদুল মুহিত

এ বছর ৮৯ বছরে পা দিয়েছেন তিনি। ঢাকার বনানীতে নিজের বাসার সোফায় বসে গত ২১ মার্চ তিনি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ব্রিটিশ ভারতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বাবা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু বাবার পথে হাঁটেননি আবদুল মুহিত। থাকতে চেয়েছেন স্বাধীন। মা সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করলেও সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। আবদুল মুহিত বলছিলেন, ‘দাদা পর্যন্ত ব্রিটিশ উপাধি থাকলেও বাবার সময় থেকে তা বন্ধ। কারণ, বাবা তখন স্বদেশি হয়ে গিয়েছিলেন।’

১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের ধোপাদীঘির পাড়ের নিজেদের বাড়িতে জন্ম আবুল মাল আবদুল মুহিতের। পরিবারের তৃতীয় সন্তান তিনি। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তাঁর বোন, যিনি এখনো জীবিত। এই বোনের বয়স এখন ৯১ বছর। মুহিতের প্রতি তাঁর ভাইবোনদের অবদান অনেক।

১৮৫৭ সালে সিপাহি যুদ্ধে সিলেটে ১৭ জনকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা আমাকে অনেক পীড়িত করে। তবে যেখানেই ছিলাম না কেন বা থাকি না কেন, সিলেট আমাকে খুব টানে। আমি আবার সিলেট যাব
আবদুল মুহিত

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই নিজের বিখ্যাত হয়ে ওঠার কথা জানান আবদুল মুহিত। বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি তেমন মেধাবী ছাত্র ছিলাম না। ম্যাট্রিকুলেশনে গিয়ে ভালো করলাম। পঞ্চম হলাম। তারও আগের একটা ঘটনা আছে, যেটাতে আমি প্রসিদ্ধ হয়ে গেলাম। এটা অবশ্য ইংরেজি জানার কৃপায়। আমার একজন ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নাম রাজন চৌধুরী। তিনি তখন এক সরকারি কর্মকর্তাকে গিয়ে বললেন, একটা ছেলে আছে, যে কিনা ইংরেজিটা খুব ভালো জানে। সে আপনার উপস্থিতিতে আপনার ওপর একটা স্বাগত বক্তব্য দিতে পারবে। ওই কর্মকর্তা একদিন স্কুলে এলেন এবং আমিও সেই স্বাগত বক্তব্য দিলাম। তখন খুব নাম হলো আমার।’

রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনা ছিল

আবদুল মুহিত ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন। পরের বছর একই বিষয়ে অর্জন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদে ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি যোগ দেন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি)।

আবদুল মুহিত বলেন, ‘সিএসপিতে আমার ফল ভালো ছিল না। অবস্থান ছিল ১৩ নম্বর। সিএসপি পরীক্ষা দিতেই ইচ্ছে করছিল না আমার। মনোভাব বুঝে আমার এক বন্ধু বলল, তুই পাগল হয়েছিস নাকি? আমি যা বলছি কর। এ কথা বলে আরেক বন্ধু লতিফুল বারীকে সাক্ষী ধরল। পরে পরীক্ষা দিলাম আরকি।’

বন্ধু মোকাম্মেল হক, প্রয়াত ফারুক চৌধুরীও অনেক মেধাবী ছিলেন বলে জানান আবদুল মুহিত। স্মরণ করেন স্কুলের বাংলার শিক্ষক দ্বিগেন্দ্রনাথকে। খুব ভালো বাংলা পড়াতেন তিনি।

নিজের বাবা সম্পর্কে বলছিলেন, ‘তাঁর খুব সুন্দর একটা বিষয় ছিল। যেকোনো বিষয়ে খুঁটিনাটি নোট রাখতেন। আর মা ছিলেন গ্রামের মেয়ে। মায়ের একজন খালাতো বোন ছিলেন ওই এলাকার সবচেয়ে শিক্ষিত। তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন তিনি। আম্মা তাঁর খালা, আমার দাদা এবং আবদুল হামিদ নামের আমার আরেক দাদার কাছ থেকে অনেক লেখাপড়া শিখেছিলেন। হামিদ দাদা টরে টক্কা (তারবার্তা পাঠানোর সাংকেতিক ভাষা) দিয়ে দাদিকে জয় করেছিলেন। দাদি এত সুন্দরী ছিলেন যে সবাই তাঁকে দেবী বলে ডাকতেন। ওই দাদিকে অবশ্য আমরা কমই দেখেছি। বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকতেন তিনি।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে মুহিতের। দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ষাটের দশকের শুরুর দিকে ২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি।

৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেটকে তিনি ৪ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন শেষে আবদুল মুহিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন। বলেন, ‘আমার খুব বাসনা ছিল। তবে বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলিনি কখনো। একমাত্র তাঁকেই বলতে পারতাম। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই।’

‘আমি আবার সিলেট যাব’

বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে সব সময় সমর্থন দিয়ে গেছেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য আবদুল মুহিত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে কোনো দিন নাম ধরে ডাকেননি। সবচেয়ে বেশি বলতেন, “মুহিত সাহেব”। কখনো বলতেন, আওয়ারস ফাইন্যান্স মিনিস্টার (আমাদের অর্থমন্ত্রী)।’

প্রিয় ব্যক্তিদের তালিকায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে রাখলেও তাঁকে এক নম্বর স্থান দেননি আবদুল মুহিত। এক নম্বর তাহলে কে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এস এম শফিউল আজম (প্রয়াত আমলা ও রাজনীতিক)। বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর মতাদর্শের বিষয়টি আলাদা। তবে তাঁর জ্ঞান ছিল না এমন কোনো বিষয় নেই।’

নাতি-নাতনি ও মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোটা তাঁর খুব প্রিয় এখন। থাকছেন বনানীর নিজের বাসাতেই। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত থাকার সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন মুহিত। এরপর প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ কারণে তাঁকে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়। তাঁর লেখা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৪০টির মতো বই রয়েছে। প্রায় ৪৫ হাজার বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালা আছে তাঁর। তাঁর লেখা এবং তাঁর কাছে থাকা বিরল কিছু তথ্য ও চিঠি নিয়ে আরও কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায়।

২০২১ সালের ২৫ জুলাই আবদুল মুহিত করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত মার্চের শুরুতে আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ১৪ মার্চ সিলেট ঘুরে আসেন। সিলেট সিটি করপোরেশন ১৬ মার্চ তাঁকে ‘গুণী শ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দেয়। ইতিহাসে সিলেটের একটি আলাদা জায়গা আছে বলে মন্তব্য করে আবদুল মুহিত বলেন, ‘১৮৫৭ সালে সিপাহি যুদ্ধে সিলেটে ১৭ জনকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা আমাকে অনেক পীড়িত করে। তবে যেখানেই ছিলাম না কেন বা থাকি না কেন, সিলেট আমাকে খুব টানে। আমি আবার সিলেট যাব।’