ফণীর কারণে দক্ষিণের মুগ ডালের রপ্তানি হ্রাস

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এবার দক্ষিণাঞ্চলে কমে গেছে মানসম্পন্ন মুগ ডালের ফলন। তাই জাপানে মুগ ডাল রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। গত মৌসুমে দক্ষিণের তিন জেলা থেকে প্রায় দেড় হাজার মেট্রিক টন মুগ ডাল রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু এবার সেখানে দেড় শ মেট্রিক টন ডাল রপ্তানির জন্য সংগ্রহ করা গেছে।

বরিশালের তিন জেলা পটুয়াখালী, ভোলা ও বরগুনা থেকে ২০১৬ সালে জাপানে মুগ ডাল রপ্তানি শুরু হয়। জাপানে এই ডালের চাহিদা থাকায় গত কয়েক বছরে রপ্তানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। তাই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকেরা ঝুঁকে পড়েন মুগ ডাল আবাদে।

ডাল রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিতে খেতে পানি জমে যাওয়ায় ডাল পরিপুষ্ট হতে পারেনি। এতে ডালের আকার ছোট হয়ে যায় এবং উৎপাদনও কমে যায়। গুণগত মান খারাপ হওয়ায় রপ্তানির জন্য চাহিদা অনুযায়ী ডাল সংগ্রহ করা যায়নি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় থেকে জানা গেছে, চলতি বছর ছয় জেলায় ৬৪ হাজার ৬৩১ হেক্টর জমিতে মুগ ডাল আবাদ হয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে উৎপাদন কিছুটা কমলেও এবার হেক্টরপ্রতি ১ দশমিক ২ মেট্রিক টন (মোট ৭৭ হাজার ৫৫৭ মেট্রিক টন) মুগ ডাল উৎপাদিত হয়েছে। রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, গত মৌসুমে বরিশালের তিন জেলা থেকে দেড় হাজার মেট্রিক টন মুগ ডাল জাপানে রপ্তানি হয়। এ বছরও একই পরিমাণ ডাল রপ্তানির প্রস্তুতি থাকলেও মানসম্পন্ন ডাল না পাওয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে আসতে হয়েছে তাঁদের। পরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ২৫০ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়। তা–ও সংগ্রহ করা যায়নি। ১৩ মে ডাল সংগ্রহ কার্যক্রম শেষ করেছেন তাঁরা। এই সময়সীমার মধ্যে পটুয়াখালীতে ১১৫ মেট্রিক টন, বরগুনায় ২৮ মেট্রিক টন ও ভোলা থেকে মাত্র সাড়ে ৩ মেট্রিক টন ডাল সংগ্রহ করা গেছে।

ভোলার ডাল রপ্তানির দায়িত্ব পাওয়া স্থানীয় বেসরকারি গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার এই প্রকল্পের ভেল্যু চেইন ফ্যাসিলিটেটর কৃষিবিদ আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় ডালের গুণগত মান বেশ খারাপ হয়েছে। তাই এবার ৫০ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলেও মান খারাপ হওয়ায় মাত্র সাড়ে ৩ টন ডাল আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি।’

গ্রামীণ ব্যাংক ও জাপানের ‘ইউগ্লেনা লিমিটেড’ যৌথভাবে এই ডাল রপ্তানি শুরু করে। বরগুনার স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সংগ্রাম ও ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও ভোলায় জন উন্নয়ন সংস্থা নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ডাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর পটুয়াখালীতে গ্রামীণ-ইউগ্লেনা লিমিটেড সরাসরি এই ডাল সংগ্রহ করছে।

সংগ্রামের ভেল্যু চেইন ফ্যাসিলিটেটর কৃষিবিদ মো. বেলাল হোসেন বলেন, এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ডাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। বরগুনায় ১০০ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলেও ২৮ মেট্রিক টন ডাল সংগ্রহ হয়েছে।

বরগুনার বামনা উপজেলার চাষি আবদুর রহিম বলেন, আগে মুগ ডালের তেমন চাহিদা ছিল না। পরিবারের জন্য সীমিত আকারে চাষ করতেন। এখন বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। মূল্যও ভালো। তাই এবার ৪০ শতকে আবাদ করেছিলেন। ২২০ কেজি বিক্রি করেছেন। ধান চাষের চেয়ে ডাল চাষে লাভ বেশি। তবে বৃষ্টির কারণে ফলন কম হওয়ায় এবং ডাল পরিপুষ্ট হতে না পারায় রপ্তানির চাহিদা কমে গেছে।

গ্রামীণ-ইউগ্লেনা লিমিটেডের উপব্যবস্থাপক মোকসেমুল ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাপানে বাংলাদেশের মুগ ডালের চাহিদা থাকলেও গুণগত মান ভালো না হওয়ায় রপ্তানি বাড়াতে পারছি না। প্রথমত, আমাদের ডালের আকার ছোট (৩ দশমিক ৫ মিলিমিটার)। কিন্তু অঙ্কুরোদ্গমের জন্য বড় আকারের ডাল প্রয়োজন। আর আমাদের বারি-৬ জাতটি এখন মিশ্র হয়ে যাওয়ায় এই জাতের বিকৃতি ঘটেছে। ফলে ডালের আকার ছোট হয়ে গেছে। পাশাপাশি আমাদের কৃষকদের চাষাবাদে প্রযুক্তির ব্যবহার কম। রপ্তানি বাড়াতে হলে উন্নত জাত উদ্ভাবন, খেতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, খেতের মধ্যে নালা তৈরি করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রেখে পরিকল্পিত চাষাবাদ প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত করা গেলে প্রচুর মুগ ডাল জাপানে রপ্তানি করা সম্ভব। সম্ভাবনার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের উচিত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে গুণগত মানসম্পন্ন মুগ ডাল বেশি উৎপাদন করা যেত। তা করা গেলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক তাওফিকুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দক্ষিণাঞ্চলে আমন ফসল ওঠার পর অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। এই সময়ে মুগ একটি সম্ভাবনাময় ফসল। তবে কৃষকেরা পরিকল্পিতভাবে এটা চাষ করে না বলে গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। এবার দুই দফায় বৃষ্টি হওয়ায় দানা পরিপুষ্ট হতে পারেনি। আগাছা দমনেও তেমন গুরুত্ব দেননি চাষিরা। ফলে মান ধরে রাখা যায়নি। আর চাষিরা তাঁদের সংগৃহীত বীজ দায়ে আবাদ করছেন। এটা বারি-৬ জাতের বিশুদ্ধতা হারানোর মূল কারণ। তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী মৌসুমে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করব, যাতে তাঁরা বিএডিসির বীজ আবাদ করেন। এ ছাড়া বীণা-৫ ও ৬ জাতের বীজও ভালো। এ ছাড়া সময়মতো আগাছা দমন, সুষম সার ব্যবহার, সেচ এবং খেতে যাতে নিষ্কাশনব্যবস্থা রাখা হয়, সে লক্ষ্যে আমরা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নেব।’