ফলচাষে পালাবদলের নায়ক

অধ্যাপক এম এ রহিম
ছবি: আনোয়ার হােসন

দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের কৃষি। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে ফল চাষের ক্ষেত্রে এসেছে অসামান্য সাফল্য। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে বছরপ্রতি ফলের উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশ পারেনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম, পেঁপেতে চতুর্দশতম। গত এক দশকে এ দেশের মানুষের ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাজারে এখন প্রায় সারা বছর পেয়ারা ও তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে, যা এক দশক আগেও ছিল কল্পনার বাইরে। দেশে ফল চাষ ও উৎপাদনের এসব সাফল্যের পেছনে রয়েছে ফলবিজ্ঞানীদের গবেষণা, জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সেসব জাত ও প্রযুক্তিকে কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম।

ফল চাষে যাঁরা এই অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ড. এম এ রহিম। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফলের ১২৩টি উন্নত জাত নিবন্ধিত হয়েছে। এসব জাতের মধ্যে অনেক জাত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। উদ্ভাবিত এসব জাতের কোনো কোনো ফল চাষ করে অনেক কৃষক বছরে কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছেন। এসব ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশের মানুষের ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা পুষ্টি উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে।

জার্মপ্লাজম হলো কোনো একটি জীবের বংশগত সম্পদ বা কৌলিসম্পদ। একই ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এর প্রতিটি জাত বা প্রকরণই একেকটি জার্মপ্লাজম। গাছের বীজ বা জীবন্ত গাছ জার্মপ্লাজম হিসেবে সংগ্রহ করে তার লালন-পালন করা হলো জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ।

শুরুর কথা

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম এ রহিম ১৯৯১ সালে মাত্র ১ একর জমি নিয়ে ফল গাছের এই জার্মপ্লাজম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মত হলো, একসময় বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে এতটা সমৃদ্ধ ছিল না। খাদ্য উৎপাদন কম হলেও তা অন্য দেশ থেকে আমদানি করে তা পূরণ করা সম্ভব। তবে বিদেশ থেকে এত মানুষের জন্য পুষ্টি কেনা সম্ভব নয়। দেশের মানুষকে সুস্থ রেখে মেধাবী জাতি গঠনে পুষ্টি উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। পুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি। তাই তিনি উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মো. আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে ফল গাছের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, উন্নয়ন এবং তা সারা দেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে শুরু করেন এই জার্মপ্লাজম সেন্টার।

প্রথমে এম এ রহিম আমের কয়েকটি জাত দিয়ে সেই ছোট জমিতে ফল গাছের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলেন। তিন দশকের ব্যবধানে সেই সেন্টার বর্তমানে ৩২ একরে বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ফলের ১১ হাজার ৫২৮টি জার্মপ্লাজম। এসব জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করতে দেশের পাহাড়, উপকূল, বন-জঙ্গল যেমন ঘুরে বেড়িয়েছেন এম এ রহিম, সেই সঙ্গে বিশ্বের ৬০টি দেশেও গেছেন। বললেন, প্রায় ৮০ শতাংশ জার্মপ্লাজম তিনি সংগ্রহ করেছেন এ দেশ থেকে, যেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ফল বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। যখন যেখানে যে ফলের যে রকম গাছ বা বীজ পেয়েছেন, সেগুলো এনে জার্মপ্লাজম সেন্টারে লাগিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

এম এ রহিম দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে দেশে চাষের উপযোগী বহু জাত উদ্ভাবন করেছেন। ফলে সেন্টারটি এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং দেশের বৃহত্তম ফল জার্মপ্লাজম সংগ্রহশালায়। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টারের সঙ্গে এর একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। অনেক দেশেই এ ধরনের সেন্টার আছে যেখানে শুধু জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে লালন ও সংরক্ষণ করা হয় অনেকটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের ধাঁচে। কিন্তু এই সেন্টারে শুধু সে কাজ না করে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম নিয়ে গবেষণা, জাত ও প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং তা সম্প্রসারণ করে দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফলচাষিদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখছে।

সেন্টারের জার্মপ্লাজম বা কৌলিসম্পদ

ফল গাছের এই জার্মপ্লাজম সেন্টারে রয়েছে দেশি-বিদেশি প্রায় ২১০ প্রজাতির ফল গাছের এক সমৃদ্ধ বাগান। দেশি ফল গাছই বেশি। এম এ রহিম বললেন, গ্রামীণ জঙ্গল দিনে দিনে উজাড় হয়ে যাওয়ায় অনেক দেশি ফলের অপ্রচলিত ফল গাছ এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ সেগুলো আমাদের মূল্যবান কৌলিসম্পদ। যেকোনো বিদেশি ফলের চেয়ে আমাদের দেশি ফলের পুষ্টি ও স্বাদ অনেক বেশি। তাই এগুলোকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।

সে জন্য এম এ রহিম প্রথমেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশি ফলের যত জাতবৈচিত্র্য বা জার্মপ্লাজম পাওয়া যায়, সেগুলোকে সংগ্রহে করতে নজর দিয়েছেন। যখনই যেখান থেকে সংবাদ পান, সেখানে তা সংগ্রহ করতে ছুটে যান। তাঁর সেন্টারটিতে রয়েছে বিভিন্ন ফল গাছের মোট ১১ হাজার ৫২৮টি জার্মপ্লাজম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আমের ১ হাজার ৮৫৮টি, লিচুর ৬৫টি, পেয়ারার ১ হাজার ১৬০টি, বিভিন্ন লেবুর ৬৬৯টি, কাঁঠালের ১০৫টি ও অপ্রচলিত ফলের ১ হাজার ২১৮টি জার্মপ্লাজম । বিদেশি ফলের জার্মপ্লাজম রয়েছে ১ হাজার ৯২৫টি।

এ ছাড়া ভেষজ গুণসম্পন্ন ফল গাছের জার্মপ্লাজম রয়েছে ১ হাজার ১৪টি। আছে আম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল, পেয়ারা, কুল ইত্যাদি প্রধান বা প্রচলিত ফলের গাছ। পাশাপাশি আছে বৈঁচি, লুকলুকি, দেশি গাব, বিলাতি গাব, অরবরই, আমলকী, আঁশফল, আতা, শরিফা, বেল, কতবেল, কাউফল, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, বুদ্ধনারকেল, কামরাঙা, করমচা, জাম, কাকজাম, বুটিজাম, ঢেপাজাম, বনজাম, খেজুর, গোলাপজাম, জলপাই, জামরুল, ডালিম, ডেফল, ডেউয়া, তেঁতুল, তৈকর, তুঁতফল, আমড়া, ফলসা, বকুল, পিরালু, বেতফল, মনফল, বিলিম্বি, সফেদা, জাম্বুরা, কালামানসি লেবু, জারা লেবু, লটকন ইত্যাদি অপ্রচলিত দেশি ফল। রক্তগোলা, গুটগুইট্টা, চাপালিশ কাঁঠাল ইত্যাদি পাহাড়ি ফলের গাছও আছে সেখানে। বিদেশি ফল গাছ আছে অ্যাভোকাডো, অলিভ, রাম্বুটান, টক আতা, পার্সিমন, আলুবোখারা, জয়তুন, ত্বীন বা মিসরীয় ডুমুর, ম্যাঙ্গোস্টিন, সালাক বা স্নেকফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট, জাবাটিকাবা, শানতোল, মিষ্টি তেঁতুল, আঙুর, কমলা ইত্যাদি।

স্বীকৃত জাত, কাজের স্বীকৃতি

এই জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফলের এ পর্যন্ত মোট ১২৩টি জাত সরকারের স্বীকৃত ও অনুমোদিত জাত হিসেবে এ দেশে চাষের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে আমের ২৫টি, কাঁঠালের ১টি, লিচুর ৫টি, পেয়ারার ১০টি জাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব জাতের মধ্যে রয়েছে বীজশূন্য পেয়ারা ও বীজশূন্য বিলাতি গাব, মিষ্টি কামরাঙা, তিনফলা আম ইত্যাদি। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এম এ রহিম প্রধানমন্ত্রী গোল্ড মেডেল, মাদার তেরেসা গোল্ড মেডেলসহ পেয়েছেন ৬০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক, পুরস্কার ও স্বীকৃতি। এই সেন্টারে এ পর্যন্ত ফল চাষ নিয়ে গবেষণা করে ৪২ জন ডক্টরেট (পিএইচডি) ও ২৫০ জন স্নাতকোত্তর (এমএস) ডিগ্রি পেয়েছেন।

ফলের আলোয়

এম এ রহিমের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে উদ্ভাবিত অনেক জাতের ফলে আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশের বহু ফলের বাগান। আনন্দের সঙ্গে এম এ রহিম বললেন, এই সেন্টার থেকে উদ্ভাবিত ফলের প্রথম জাতটি ছিল ‘বাউকুল ১’। প্রথম নিবন্ধিত সেই জাতের কুল এ দেশে কুল চাষে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। শীতকালে যেখানে এ দেশে ফল নেই, সেখানে শীতকালে বাউকুল ফলচাষিদের কাছে বিরাট স্থান করে নেয়। দেশে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে বাউকুলের বাগান গড়ে উঠেছে, যেখান থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টন কুল উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি এই জাতের চাষ বিদেশেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে এই সেন্টার থেকে তাঁর একজন পিএইচডি ছাত্র মনিরুজ্জামান বাউকুল ও আপেল কুলের সংকরায়ণ করে উদ্ভাবন করেছেন হাইব্রিড জাতের ‘বলসুন্দরী কুল’। কুলের এ জাতও সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উদ্ভাবিত ‘বাউ ড্রাগন ফল ১’ ও ‘বাউ ড্রাগন ফল ২’ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে; বিশেষ করে বান্দরবানসহ পার্বত্য অঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকা ও উত্তরবঙ্গের খরাপ্রবণ এলাকাতেও এসব জাতের ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছে। ড্রাগন ফলের আরও দুটি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। সেগুলোরও সম্প্রসারণ চলছে। ইতিমধ্যে ‘বাউ আম ১৪’ বা ব্যানানা ম্যাঙ্গো প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও শহরে চাষ হচ্ছে, যার মাধ্যমে ফলচাষিরা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।

ফলচাষে বিপ্লব

অনেক ফলচাষি এই জার্মপ্লাজম সেন্টারের উদ্ভাবিত ফলের নতুন নতুন উন্নত জাত চাষ করে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, এর পেছনে রয়েছে এম এ রহিমের অবদান। অনেক গরিব কৃষক ফল চাষ করে ধনী হয়েছেন, আবার অনেক ধনী ব্যক্তিও তাঁদের বিপুল জমি ফেলে না রেখে ফল চাষে আগ্রহী হয়েছেন।

এম এ রহিম বললেন, চুয়াডাঙ্গার হাফেজ আক্তার হোসেন গত বছর ৩০ বিঘা জমিতে বাউকুল চাষ করে প্রায় ১ কোটি টাকার কুল বিক্রি করেছেন। ঈশ্বরদী, পাবনার শাহজাহান আলী বাদশা ওরফে পেঁপে বাদশা বাউকুল চাষ করে পেয়েছেন ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। নাটোরের গোলাম নবী ৫ হাজার পিলারে ড্রাগন ফলের চাষ করে প্রতি বছর দু–তিন কোটি টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করছেন। নাটোরের সেলিম রেজা মাত্র ২ একরে ড্রাগন ফলের চাষ করে গত বছর প্রায় ২০ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। এ রকম উদাহরণের যেন শেষ নেই।

এম এ রহিম আরও বলেন, ‘বাউ আম ২৩’ ও ‘বাউ আম ২৪’ নামে আমের দুটি নতুন জাত সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ জাত দুটির আম অনেক বড়, প্রতিটি আমের গড় ওজন দেড় থেকে দুই কেজি, নাবি জাত বিধান। তাঁরা প্রত্যাশা করছেন, এই জাত দুটিও জনপ্রিয় হবে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

ছবি তুলেছেন: মো. আনোয়ার হোসেন, ময়মনসিংহ