ফারমার্স ব্যাংক নিয়ে ফাঁপরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিপাকেই পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ তুলতে গিয়ে আমানতকারীদের বেশির ভাগই খালি হাতে ফিরছেন। অনেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়েও টাকা তোলার চেষ্টা করছেন। তাতেও তাঁরা টাকা পাচ্ছেন না। এতে পুরো ব্যাংক খাতে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুজন গভর্নর। তাঁরা বলেছেন, ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। না হলে পুরো ব্যাংক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা কারও জন্য সুখকর হবে না।

অবশ্য আরেকজন সাবেক গভর্নর বিশ্বাস করেন, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব পদক্ষেপই নেবে।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ফারমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী। পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তাঁরা। গত মঙ্গলবার ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সময় নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট কাটছে না।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাতে করে ব্যাংকটির পুরো দায়িত্ব চলে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। পরিস্থিতির উত্তরণ হলে উদ্যোক্তাদের হাতে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব ফিরে যাবে।

 বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের মেয়াদকালে ব্যাংকটি অনুমোদন পেয়েছিল। তাঁর সময়েই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছিল। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল ফারমার্স ব্যাংক।

 এমন পরিস্থিতিতে কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, এই প্রশ্নের জবাবে আতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এখনই ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে ব্যাংকটির দায়িত্ব নেবে। এভাবে ছয় মাস চলার পর পরিস্থিতির উন্নতি হলে পরিচালকদের হাতে ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যতে পারে। তবে ব্যাংকটিতে একটা বড় সময় ধরে পর্যবেক্ষক রাখতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বিলম্ব করলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকগুলোতেও পড়বে।

ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগেভাগেই বোঝা উচিত ছিল বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এখন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা অনেক আগেই নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস রয়েছে। আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব পদক্ষেপই নেবে। আজকে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তা এক দিনে তৈরি হয়নি। ছয়-সাত বছর ধরে এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব পদক্ষেপই নেবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হলেই প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে বা অন্য কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে ব্যাংকটির দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী যে সুযোগ আছে, প্রয়োজনে সবই প্রয়োগ হবে। ব্যাংক খাত ও আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি চিন্তা করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, প্রশাসক দেওয়ার পর ব্যাংকটির জন্য বিশেষ কর্মসূচি বা স্কিমের পরিকল্পনা রয়েছে। ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রেখে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করতেই মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এ কর্মসূচি নেওয়া হলে ধাপে ধাপে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকটি।

এর আগে ২০০৮ সালে বেসরকারি খাতের ওরিয়েন্টাল ব্যাংক পুনর্গঠন স্কিম গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানারও হাতবদল ঘটে। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকটি এখন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে টিকে আছে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন ৯ ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়ার আগেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দপ্তর খুলে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছিল ব্যাংকটি। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে নতুন এই ব্যাংক, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।