বন্ড থেকে ধার বাড়িয়েছে ইসলামি ব্যাংকগুলো

>• সরকারের ইসলামি বন্ড
• ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কমে হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা
• তহবিলসংকটের কারণে ৫০০ কোটি টাকা ধার করেছে


তহবিলসংকটে ভুগছে দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো। তাই সংকট কাটাতে এসব ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের ইসলামি বিনিয়োগ বন্ড থেকে টাকা ধার করছে। এ বন্ড চালুর পর সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছিল ইসলামী ব্যাংক। এখন ব্যাংকটি তহবিলসংকটে পড়ে সরকারের বন্ড থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পাশাপাশি সেখান থেকে টাকা ধার করছে। আর সরকারের বন্ডের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা হয়ে উঠেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। সরকারের ইসলামি বিনিয়োগ বন্ডের গত ৩ মের হিসাব বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য মিলেছে।

জানতে চাইলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, ‘আস্থার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকে তারল্য-সংকট চলছে। এ জন্য সরকারের বন্ড থেকে ব্যাংকগুলো টাকা ধার করছে। যেসব ব্যাংক বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ধার করেছে, তারা বড় ধরনের সংকটে আছে।’

প্রচলিত ব্যবস্থার ব্যাংকগুলো সরকারের বিভিন্ন ট্রেজারি বিল, বন্ডে টাকা খাটাতে পারে। ব্যাংকগুলোর আমানতের বিপরীতে যে সংবিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে হয়, এসব বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে তা পূরণ করতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমেও টাকা ধার নিতে পারে।

ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো সরাসরি সুদের হিসাব না করায় এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ জন্য সরকার ২০১৫ সাল থেকে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য ইসলামি বিনিয়োগ বন্ড চালু করে। ব্যাংকগুলো এ বন্ডে বিনিয়োগ করে মুনাফা পায়। আবার এসব বিনিয়োগকে এসএলআর হিসেবেও দেখাতে পারে। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো তহবিলসংকটে পড়লে এ বন্ড থেকে ধার করতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামি ধারার ব্যাংক, শাখা ও উইন্ডো কার্যক্রম থেকে ১০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয় সরকারের ওই বন্ডে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডেরই বিনিয়োগ ছিল ৫ হাজার ২০৭ কোটি টাকা, তবে কোনো ঋণ ছিল না। ওই বছর এ বন্ড থেকে ব্যাংকগুলো ধার করেছিল মাত্র ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

আর এখন এ বন্ডে ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কমে হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। তহবিলসংকটের কারণে ব্যাংকটি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পাশাপাশি এ বন্ড থেকে ৫০০ কোটি টাকা ধার করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর যে হারে আমানত বেড়েছে, ঋণ বেড়েছে তার অনেক বেশি। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়েছে।

এ ছাড়া অর্থসংকটে পড়া এবি ব্যাংক সরকারের ইসলামি বন্ডে ২৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও ধার করেছে ২২০ কোটি টাকা। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চরম অর্থসংকটে পড়া প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটি ২০১৭ সালে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশও দিতে পারেনি।

আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক সরকারের বন্ডে ৭৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও ধার করেছে ১ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা ব্যাংক ৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ৩০০ কোটি টাকা ধার করেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ধার করেছে।

সংকটে থাকা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এ বন্ডে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১৮৯ কোটি টাকা ধার করেছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৮ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ধার করেছে ৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরে এ বন্ডে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে ৯০০ কোটি ও ঋণ ৭০০ কোটি টাকা, শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ ৮৫৫ কোটি ও ঋণ ৭০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকের বিনিয়োগ ৪৭৫ কোটি ও ঋণ ৮০০ কোটি টাকা।

যোগাযোগ করা হলে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকে কোনো তারল্য-সংকট নেই। এত টাকা ধার নেওয়ার বিষয়টি আমি নিশ্চিত না।’

বর্তমানে দেশে ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের ১ হাজার ১২৪টি শাখার মাধ্যমে দেশে ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আরও ৯ ব্যাংকের ১৯টি শাখা ইসলামি ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে। পাশাপাশি ৮ ব্যাংকের ২৫টি ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে।

গত ডিসেম্বর শেষে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, যা পুরো খাতের আমানতের ২৩ শতাংশ। এ সময়ে ঋণ বা বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা, যা পুরো খাতের ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশ।