বরিশালের সকাল সন্ধ্যা থেকে বনানীর ই-কুরিয়ার

নব্বইয়ের দশকে যখন বিপ্লব ঘোষের জন্ম, বিপ্লবের বাবা বিশ্বজিৎ ঘোষ বরিশালের বিখ্যাত সকাল সন্ধ্যা মিষ্টির দোকানের মালিক। খোদ বরিশালেই তাঁদের শাখা আছে পাঁচটি। কিন্তু টেলিকমিউনিকেশনে পড়া বিপ্লব, ব্যবসায়ী বংশধারা আর কোডিং শিক্ষা নিয়ে তৈরি করেছেন একটি আধুনিক কুরিয়ার সার্ভিস, ই-কুরিয়ার। সম্প্রতি ৩০০ কোটি টাকা মূল্যমানের কোম্পানি হিসেবে খবরে উঠে আসে ই-কুরিয়ার ও এর প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লব।

বনানীতে ই–কুরিয়ারের বেশ একটা আটপৌরে অফিস। সেখানেই প্রায় এক শ কর্মী নিয়ে কাজ করছেন বিপ্লব। এখানে একসঙ্গে চলে দুটি প্রতিষ্ঠান, একটি কল সেন্টার—নাম লিংকিং লুপস এবং কুরিয়ার সার্ভিস ই-কুরিয়ার। বিপ্লবের ভাষায়, তারা একে অপরের পরিপূরক। একফাঁকে জানিয়ে রাখেন গুলশানেও আছে আরেকটি অফিস, যেখানে কাজ করেন আরও এক শ কর্মী। যদিও বিপ্লবের শুরুটা হয়েছিল মাত্র দুটি সাইকেল নিয়ে, যা এখনো বেঁচে আছে ই-কুরিয়ারের লোগোতে।

২০১৩ সালের শেষে ফেসবুক গ্রুপ ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেবো’র এক মেলায় আত্মপ্রকাশ করে ই-কুরিয়ার। কুরিয়ার কোম্পানি খোলার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, জানান বিপ্লব। ই-কুরিয়ারের আগে বিপ্লবের একটি কল সেন্টারের অংশীদারী ব্যবসা ছিল। তাদের গ্রাহক ছিল বিভিন্ন কুরিয়ার কোম্পানি। বিপ্লব দেখলেন, কোম্পানিগুলোর পণ্য ট্র্যাকিং ব্যবস্থা খুব এলোমেলো। তা ছাড়া পণ্য ঠিক প্রেরকের হাত থেকে নিয়ে গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানো হয় না। তিনি একটি কুরিয়ার কোম্পানিকে প্রস্তাব দিলেন সবকিছু গুছিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা দাঁড় করাতে, যা থাকবে তাঁদের কল সেন্টারের আওতায়।

‘আমার পরিকল্পনা তাদের খুব পছন্দ হয়। তারা আমাকে সেই প্রোগ্রাম তৈরি করে দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানির লভ্যাংশ দেওয়ার প্রস্তাব করে।’ বলেন বিপ্লব। নিঃসন্দেহে এত বড় প্রস্তাব লুফে নেন তিনি। শুরু হয় পুরো ব্যবস্থাপনাটিকে দাঁড় করানোর কাজ। ৯ মাস ধরে চলে বিশ্বে কুরিয়ার ব্যবস্থাকে নিয়ে গবেষণা আর প্রোগ্রাম লেখা। কিন্তু ৯ মাস পর যখন সব তৈরি তখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কুরিয়ার কোম্পানিটি।

‘আমার তখন অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ৯ মাস ধরে আমার সঙ্গে তিনজন কর্মী কাজ করেছেন বিষয়টিকে দাঁড় করাতে। অংশীদারি কোম্পানি সফট কলের সঙ্গে আমার ঝামেলা শুরু হয় এবং বলতে গেলে আমি খালি হাতেই সেখান থেকে বের হয়ে আসি।’

ই-কুরিয়ারের বিপ্লব ঘোষ
ই-কুরিয়ারের বিপ্লব ঘোষ

কিন্তু যেহেতু পণ্য তৈরি আছে আর হারানোর কিছু আর অবশিষ্টও নেই। বিপ্লব লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর পণ্য ই-কুরিয়ারকে একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ দেন। দুটি মাত্র সাইকেল দিয়ে শুরু করেন কাজ। তখনই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কিছু তরুণকে হংকং পাঠায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার ওপর পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমার জন্য। সে দলে সুযোগ পান বিপ্লব। হংকংয়ে সেই ডিপ্লোমায় বিপ্লবের পরিচয় মাইনস ইনিশিয়েটিভ নামে একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। মাইনস শেয়ার চাইছিল একটি কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে, বিপ্লবের শর্ত ছিল চলবে ই-কুরিয়ারও। পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো বড় হতে থাকে লিংকিং লুপস ও ই-কুরিয়ার।

২০১৪ খুব জরুরি একটা সময়, বলেন বিপ্লব। কারণ, তখন একে একে ই–কমার্স, এফ কমার্স সাইটগুলো আসতে শুরু করে। তাদের পণ্য পরিবহনের কাজ করতে করতে দ্রুতই দাঁড়িয়ে যায় ই-কুরিয়ার। এখন ই-কুরিয়ারের নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ১৫ হাজার, নিয়মিত সেবা দেওয়া হয় প্রায় ৪ হাজার গ্রাহককে। নিয়মিত গ্রাহকের তালিকায় আছে গ্রামীণফোন, রবির মতো প্রতিষ্ঠান, আবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ নথি আনা–নেওয়ার কাজ করে ই-কুরিয়ার। শাড়িজ বাই শাকিলার মতো শতভাগ ফেসবুক ব্যবসাগুলোর সঙ্গেও কাজ করে ই-কুরিয়ার।

বিপ্লব বলেন, ‘ই-কুরিয়ার তৈরির আগে আমি বিষয়টি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। এখান থেকে আমি বাংলাদেশের প্রচলিত কুরিয়ার ব্যবস্থার অনেক ত্রুটি খুঁজে পেয়েছি। যেমন কুরিয়ার কোম্পানির কাছে পণ্য বিক্রেতার কোনো তথ্য থাকে না। ক্রেতারা তাঁদের পণ্য ঠিক ঘরে বসেই পান না, নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। আবার বিক্রেতাকেও পণ্য দিতে কুরিয়ারের অফিসে আসতে হয়। আমরা এসব ত্রুটি দূর করেছি। চেষ্টা করেছি শতভাগ ফেসবুক পেজভিত্তিক ব্যবসাগুলোর জন্য পেজ চলানোর উপযোগী সেবা দেওয়ার। ফলে সব মিলিয়ে ই-কুরিয়ার এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে গ্রাহক ও প্রেরক অনেকগুলো সেবা পান।

২০১৯ সালে এসে ই-কুরিয়ারে বিনিয়োগ করে একটি হংকংভিত্তিক চীনা কোম্পানি। তখন তারা ই-কুরিয়ারের মূল্যমান করে ৩০০ কোটি টাকায়। বিপ্লব বলেন, ‘ই-কুরিয়ার খুব ভালো চলছিল, তা–ও এই বিনিয়োগটা খুব উপকারে আসে। আমরা এখন কাজ করছি জেলা পর্যায়ে। প্রতিটি জেলায় একটি পিক–ড্রপ সেন্টার তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া ই–কুরিয়ার দিচ্ছে গ্রামপর্যায়ের ইন্টারনেট সেবাও।’