বাংলাদেশ যেন ‘ফাঁদে না পড়ে’

ফিলিপাইন ৩৪ ও ভারত ১৩ বছর ধরে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে আটকে আছে। ফাঁদ এড়াতে দেশে সংস্কার দরকার।

বাংলাদেশের অর্থনীতি আরেক ধাপ উত্তরণের পথে রয়েছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এই উত্তরণ প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না পাওয়া, বৈষম্য বৃদ্ধি, অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা হারানোর মতো নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও বড় বাধা হতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক কৌশল ও উদ্যোগ নিতে না পারলে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর: অতীতে দৃষ্টিপাত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে গতকাল মঙ্গলবার বক্তারা এসব কথা বলেন। ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তর’। সিপিডি এই সম্মেলন আয়োজন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচির সহায়তায়।

এ অধিবেশনের সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, উন্নয়নের পথে নানা ধরনের ফাঁদ থাকবে। সঠিক নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করে এই ফাঁদ অতিক্রম করতে হবে। সুশাসনের ঘাটতির সমস্যার সমাধান করতে হবে। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে উন্নত জীবনমান লাগবে। আবার পর্যাপ্ত অবকাঠামো, ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ এবং সুষম শিল্পায়নও প্রয়োজন।

ফাঁদে পড়ার শঙ্কা

অধিবেশনে তিনটি মূল প্রবন্ধের একটি উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এতে তিনি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া এবং উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, তা তুলে ধরেন। সঠিক উদ্যোগ না নেওয়া হলে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নয়টি কারণে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়তে পারে। কারণগুলো হলো ১. প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া। ২. মানবসম্পদে কম বিনিয়োগ। ৩. জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ থাকার সুবিধা নিতে না পারা। ৪. বৈষম্য বৃদ্ধি। ৫. বিদেশি বিনিয়োগের নিম্ন প্রবাহ। ৬. গবেষণা ও উন্নয়নে ঘাটতি এবং প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও উৎপাদনের উৎকর্ষের অভাব। ৭. উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা এবং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল বাজারসুবিধার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারা। ৮. অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কম সম্পদ আহরণ এবং ৯. দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও সুশাসনে ঘাটতি।

মোস্তাফিজুর রহমান উদাহরণ দেন যে ভারত ১৩ বছর, ভিয়েতনাম ১১ বছর ও ফিলিপাইন ৩৪ বছর ধরে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে আটকে আছে। মালয়েশিয়া ২৮ বছর এবং আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ৩৩ বছর ধরে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় রয়েছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ এই উপস্থাপনার ওপর আলোচনায় বলেন, উত্তরণ প্রক্রিয়ায় সবদিকে প্রস্তুতি থাকতে হবে। তাহলেই উন্নয়ন টেকসই হবে।

‘প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বড় সমস্যা’

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে বড় সমস্যা বলে মনে করেন আরেক প্রবন্ধ উপস্থাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অন্যতম বাধা হলো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি। যেকোনো সংস্কার উদ্যোগ সংস্কারবিরোধী জোট ও দুর্নীতিবাজদের চক্র বাধা দেয়। সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

এই উপস্থাপনার ওপর আলোচক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, জিডিপি–বিনিয়োগ অনুপাত একটি হারের মধ্যে আটকে আছে। কর-জিডিপি অনুপাত এখনো সর্বনিম্ন। এসব মৌলিক সংস্কার না হলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়বে।

‘নীতি প্রণয়নে সমন্বয় দরকার’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, যেকোনো সফল নীতি গ্রহণের জন্য জ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা, সহায়ক রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, জনগণের মতামত, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইচ্ছা, আমলাতন্ত্রের সহায়তা—ইত্যাদির সমন্বয় করতে হয়। এ উপস্থাপনার ওপর আলোচক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভালো করবে।

অনুষ্ঠানে অংশ নেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও বিশেষ ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। সিপিডির সম্মেলনে আজ বুধবার সামাজিক রূপান্তর ও সংস্কৃতি নিয়ে দুটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।