বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাতকাহন

প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে এখন মুদিখানার নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে বিলাস পণ্য—সবকিছুরই দাম বেশ চড়া। এ কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালের পর সারা পৃথিবী এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে রয়েছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হচ্ছে—জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য, ভোগ্যপণ্য ও গৃহস্থালির উপকরণের সরবরাহে ঘাটতি, পরিবহন ও শিপিংভাড়ার ঊর্ধ্বমুখিতা, মজুরি বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাণিজ্য বাধা এবং মহামারিকেন্দ্রিক সহায়তা হ্রাস।

১. জ্বালানি ও পেট্রোলের দাম বাড়ছে

করোনা মহামারির শুরুতে বিমান চলাচলসহ সব ধরনের যাতায়াত কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে তেলের দাম আবার বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই চাহিদা এখন অনেকটাই যেন লাগামহীন হয়ে পড়েছে। চলতি সপ্তাহে তো তেলের দাম বেড়ে গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এক গ্যালন তেলের গড় দাম ৩ দশমিক ৩১ ডলার। এক বছর আগে যা পাওয়া যেত ২ দশমিক ৩৮ ডলারে। বাড়তি মূল্যের একই চিত্র বিরাজ করছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতেও।

তেলের পাশাপাশি বেড়েছে গ্যাসের দামও। গত বছর (২০২১ সাল) ইউরোপে তীব্র শীতে গ্যাসের মজুত কমেছে। আর এ বছর এশিয়ার দেশগুলোতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে এই জ্বালানি পণ্যের।

২. ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি, জোগান হ্রাস

মহামারির পরিস্থিতিতে দাম বেড়েছে অনেক দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্যের। গত বছর দেশে দেশে দীর্ঘ লকডাউন বা বিধিনিষেধের সময় বাড়িতেই আটকে থাকতে হয় নাগরিকদের। তখন থেকেই ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্ধিত সেই চাহিদার তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ ছিল কম। তাই পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
বিবিসি জানায়, বিদায়ী ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে কাঠের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি ছিল, আর যুক্তরাষ্ট্রে তা ছিল দ্বিগুণের বেশি। গাড়ি, কম্পিউটার তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ মাইক্রোচিপসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনে ঘাটতির কারণেও বাজরে মূল্যস্ফীতি ঘটে।

৩. পরিবহন ও শিপিংভাড়া বৃদ্ধি

মহামারির প্রকোপ কমার পর থেকে সারা বিশ্বে পণ্য সরবরাহের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবহন সংস্থাগুলো। এর মানে হলো, আমদানিকারক হয়ে বিক্রেতাদের হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে খুচরা বিক্রেতাদের ওপর। অর্থাৎ ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
বিবিসি জানিয়েছে, এশিয়া থেকে ইউরোপে সমুদ্রপথে একটি ৪০ ফুটের কনটেইনার পাঠাতে বর্তমানে ১৭ হাজার ডলার খরচ হয়, যা গত বছরের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। বিমানে পণ্য পরিবহনের খরচ এমনিতেই বেশি। সেই ভাড়া এখন আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপজুড়ে ট্রাকচালকের সংকট পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দিচ্ছে।

৪. মজুরি বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রে গত বছরের এপ্রিল মাসে ৪০ লাখের বেশি লোক চাকরি ছেড়ে দেন। মহামারিকালে অনেক দেশেই বহু লোকের এভাবে কাজ ছেড়ে দেওয়া কিংবা চাকরি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে গাড়িচালক, বাবুর্চি কিংবা রেস্তোরাঁর ওয়েটারের মতো কর্মীর সংকটে পড়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে আগের চেয়ে বাড়তি মজুরি বা বোনাস দিয়ে তাদের কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত খরচের এই অর্থ কিন্তু আদায় করে নিচ্ছে ভোক্তাদের কাছ থেকে।

৫. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আবহাওয়া চরম বিরূপ আকার ধারণ করেছে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। মেক্সিকো উপসাগরে সৃষ্ট হ্যারিকেন বা ঘূর্ণিঝড় ইডা ও নিকোলাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া গত বছর শীতকালেও তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে মাইক্রোচিপ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যে অবস্থিত বড় কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মাইক্রোচিপ উৎপাদন কমে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বাজারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে কফি উৎপাদনেও। বিশ্বের বৃহত্তম কফি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল গত বছর প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক খরার মুখে পড়ে। যে কারণে দেশটিতে কফি উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে। ফলন খারাপ হওয়ার পরিণতিতে বৈশ্বিক বাজারে কফির দাম বেড়েছে।

৬. বাণিজ্য বাধা

মহামারির মধ্যেও বিশ্ববাণিজ্যে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপের রাজনীতি দেখা গেছে। এই যেমন হুয়াওয়েসহ চীনা কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। আবার ব্রেক্সিট-পরবর্তী নতুন বাণিজ্যিক নিয়মের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যে পণ্যের আমদানি মূল্য বেড়েছে। ফলে আমদানির পরিমাণ কমেছে। আর ব্যয়বহুল আমদানির পরিণতিতে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

৭. মহামারিকেন্দ্রিক সহায়তা কমছে

বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো করোনভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যবসায়ীদের দেওয়া বিভিন্ন সহায়তা একেক করে বন্ধ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যয় ও ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন দেশে করের হার বাড়িয়েছে সরকারগুলো। অধিকাংশ মানুষের মজুরি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। এ অবস্থায় অনেক উন্নত অর্থনীতিতে কর্মীদের সুরক্ষা দিতে সর্বনিম্ন বেতন বজায় রাখতে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু কিছু অর্থনীতিবিদ বলছেন, এসব নীতি মূল্যস্ফীতিকে আরও ওপরে ঠেলে দিতে পারে।