বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ কে, গরিব কারা, বাংলাদেশই বা কোথায়

শীর্ষ ধনী দেশ কাতার

সবচেয়ে ধনী দেশ বলতে আসলে আমরা কাকে বুঝি। প্রশ্ন করলে বেশির ভাগই হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলবেন। বিশ্বের সবচেয়ে শতকোটিপতির বাস এই দেশটিতে। আয়তনে বড়, ক্ষমতায়ও বড়। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ভিত্তিতে হিসাব করা হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নামটি সবার আগে আসবে, আর তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে চীন।

তবে একটি দেশ কত ধনী, তা কিন্তু জিডিপি দিয়ে বোঝানো যাচ্ছে না। জিডিপির সমস্যা অনেক। বড় সমস্যা এর বণ্টন। বিশেষ করে একটি দেশের নাগরিকেরা কেমন আছে, সেটা ঠিক জিডিপি দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে একটি উপায় হতে পারত মাথাপিছু জিডিপি। অর্থাৎ মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা। সমস্যা আছে এখানেও। এটা গড়ের হিসাব। কারও আয় হয়তো অনেক বেশি, অন্যরা কোনোরকম মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে। একটি দেশের মানুষের সঠিক অবস্থানটা আসলে মাথাপিছু আয় দিয়ে বোঝা যাবে না। আয়ের বৈষম্য প্রকট হলে মাথাপিছু আয় দিয়ে ভালোমন্দ বিবেচনা করা যায় না। বাকি রইল ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেইজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি)।

একটি দেশের নাগরিকেরা আসলেই কতটুকু সম্পদশালী, সেটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু। যে অর্থ আয় করে তা দিয়ে সে কী কী কিনতে পারে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটি দেশের কোনো পণ্যের দর অন্য দেশের সঙ্গে মিলবে না। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে তুলনার জন্য পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির আকার হিসাব করা হয়। মূলত একটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়। ধরা যাক, বাংলাদেশে ১০০ টাকা দিয়ে একগুচ্ছ পণ্য ও সেবা ক্রয় করা যায়, যা কিনতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয় হয় ২ ডলার। এই হিসাবে মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় মূল্য দাঁড়াবে ৫০ টাকা। অর্থাৎ পিপিপিতে ১ ডলার সমান ৫০ টাকা।

এখন দেখা যাক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কোন কোন দেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য নিয়ে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন ও হাউমাচ ডটনেট এই তালিকা তৈরি করেছে।

১০. সুইজারল্যান্ড

পিপিপি ডলারে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৬৭ হাজার ৬০০ ডলার। সুইজারল্যান্ড মানেই কেবল ঘড়ি, সাদা চকলেট, সুইস চাকু বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়। পর্যটন তো আছেই, ভারী শিল্পের জন্যও বিখ্যাত দেশটি। সুইজারল্যান্ডের আর্থিক সেবার সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। কোটিপতির ঘনত্বের দিক থেকেও দেশটি সবার ওপরে। প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৯ হাজার ৪২৮ জনই কোটিপতি।
শীর্ষ ধনী দেশের একটি হয়েও কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পায়নি দেশটি। সুইজারল্যান্ডের উৎপাদন কমেছে ৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে খারাপ মন্দার মধ্যে যাচ্ছে তারা।

৯. কুয়েত

কুয়েত

পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি ৬৭ হাজার ৯০০ ডলার। ১৯৩৪ সালে প্রথম মরুভূমির এই দেশে খনিজ তেল পাওয়া গিয়েছিল। সেই শুরু কুয়েতের উত্থান। বিশ্বের মোট তেলের ৬ শতাংশই কুয়েতের। কুয়েতের জিডিপির ৪০ শতাংশ আসে তেল থেকে, রপ্তানির ৯০ শতাংশই তেল। কুয়েতের জনসংখ্যা মাত্র ৪১ লাখ। এর ৩০ লাখই অভিবাসী। তেলের দাম কমে যাওয়ায় কুয়েত অবশ্য ২০১৫ সাল থেকেই বিপদে আছে।

৮. সংযুক্ত আরব আমিরাত

পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৭০ হাজার ৪০০ ডলার। শুরুতে দেশটি নির্ভরশীল ছিল কৃষি, মাছ ধরা ও মুক্তার ওপর। ১৯৫০ সালে তেল আবিষ্কারের পর থেকে বদলে যায় পুরো দেশটি। এখন অবশ্য দেশটির কেবল তেলের ওপর একক নির্ভরশীলতা নেই। বাণিজ্য, নির্মাণ ও পর্যটন থেকেও দেশটির আয় আছে। কোভিডের কারণে এবার দুবাই ওয়ার্ল্ড এক্সপো করতে পারছে না, এটা একটা বড় ধাক্কা। এই এক্সপোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আড়াই কোটি মানুষ অংশ নেন।

৭. নরওয়ে

পিপিপিতে মাথাপিছু আয় ৭৯ হাজার ৬০০ ডলার। ১৯৬০ সালে এখানে তেল আবিষ্কার হয়। যত দিন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছিল, তত দিন দেশটির সমৃদ্ধি কেবলই বেড়েছে। এখন যে খুব বিপদে আছে, তা–ও নয়। আয়ের বৈষম্যের দিক থেকে নরওয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে।

ব্রুনেই দারুস সালাম

৬. ব্রুনেই দারুস সালাম

পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ৮৫ হাজার ডলার। ১ হাজার ৭৮৮টি কক্ষ, ২৫৭টি বাথরুম, ৫ হাজার অতিথির সংকুলান হবে এমন একটি হলরুম, পোলো খেলার জন্য ২০০ ঘোড়ার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবল—এই হচ্ছে দেশটির সুলতান হাসসান-আল বলখিয়াহর থাকার প্রাসাদের ছোট্ট এক বিবরণ। তেলসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে দেশটির। আবার আয়ের বৈষম্য ও পুষ্টিহীনতাও প্রকট। সাড়ে চার লাখ অধিবাসীর এই দেশে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের আয় বছরে এক হাজার ডলারের কম। কোভিড-১৯–এ শুরুতে আক্রান্ত হলেও এখন প্রায় মুক্ত।

৫. আয়ারল্যান্ড

পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৮৭ হাজার ডলার। কোভিড-১৯–এর আগে ব্রেক্সিট, বাণিজ্যযুদ্ধ, উদ্বাস্তুসহ নানা সমস্যায় যখন ইউরোপ ছিল জর্জরিত, তখনো আয়ারল্যান্ড ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পুরো ইউরোপের প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ, আর আয়ারল্যান্ডের সাড়ে ৫ শতাংশ। মাত্র ৫০ লাখ মানুষের দেশটি শুরুতে অবশ্য বিপদেই পড়ে গিয়েছিল করোনার কারণে। কিন্তু বেতন কমানো, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও কিছু আর্থিক সিদ্ধান্তের কারণে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠছে।

৪. সিঙ্গাপুর

পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ ডলার। এশিয়ার অন্যতম করের স্বর্গরাজ্য বা ট্যাক্স হ্যাভেনের দেশ। অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না, করও ধরতে গেলে খুবই কম। এ জন্য অনেকেই সিঙ্গাপুরের মতো ছোট্ট এই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে আগ্রহী। এই যেমন, ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা এডুয়ার্দো স্যাভেরিন। ২০১১ সালে তিনি কোম্পানির ৫ কোটি ৩০ লাখ শেয়ার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে চলে আসেন।
১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়ার সময় দেশটির তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম, স্মার্ট নীতি ও সঠিক নেতৃত্বের গুণে সিঙ্গাপুর এখন অন্যতম ধনী দেশ।

লুক্সেমবার্গ

৩. লুক্সেমবার্গ

পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ১২ হাজার ডলার। ইউরোপের আরেক ট্যাক্স হ্যাভেন বা করস্বর্গ। এমন অনেকেই আছেন দেশটিতে যান, একটা ব্যাংক হিসাব খোলেন, তারপর আর যাওয়ার প্রয়োজনই হয় না। সর্বোচ্চ মানের জীবনযাপনের দেশ লুক্সেমবার্গ। বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায়। ২০১৫ সালে প্রথম দেশটির মাথাপিছু আয় এক লাখ ডলার অতিক্রম করে। এরপর আর তাদের পেছন ফিরতে হয়নি। এমনকি মহামারিতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের আয় খুব একটা কমবে না।

২. ম্যাকাউ

পিপিপি জিডিপিতে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৩৬২ ডলার। এশিয়ার জুয়ার রাজধানী এই ম্যাকাউ। সম্ভবত দেশটি শিগগিরই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হয়ে যাবে। একসময় পর্তুগিজদের উপনিবেশ ছিল, ম্যাকাউ এখন চীনের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। মাত্র ৬ লাখ অধিবাসীর এই অঞ্চলে ৪০টির বেশি ক্যাসিনো আছে। করোনার কারণে ক্যাসিনো বন্ধ ছিল, গত জুলাই থেকে আবার খুলে দেওয়া হয়েছে।

১. কাতার

পিপিপি জিডিপিতে দেশটির মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ ডলার। বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশ। ২০ বছর ধরেই তারা শীর্ষ ধনী দেশের অবস্থান ধরে রেখেছে। এর অধিবাসী মাত্র ২৮ লাখ। আবার এর ১২ শতাংশ স্থানীয়। তবে তেলের দাম কমে যাওয়ায় খানিকটা বিপদে আছে। ২০১৪ সালের পর থেকে কাতারের অধিবাসীর মাথাপিছু আয় প্রতিবছর কমছে ১৫ হাজার ডলার। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল কাতারে হবে। এ জন্য চলছে ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ।

কোন মহাদেশে কে বেশি ধনী

এ তো গেল বিশ্ব তালিকা। এবার দেখা যাক কোন মহাদেশে কোন কোন দেশ শীর্ষ ধনী

এশিয়া: শীর্ষ দশের প্রথম নামটি অবশ্যই কাতার। এরপরের ৯টি দেশ হচ্ছে ম্যাকাউ, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই দারুস সালাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, হংকং ৬৬ হাজার ৫০০ ডলার), তাইওয়ান (৫৭ হাজার ২০০ ডলার), সৌদি আরব (৫৬ হাজার ৯০০ ডলার) এবং বাহরাইন (৫২ হাজার ডলার)।

ইউরোপ: লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সান ম্যারিনো (৬২ হাজার ৯০০ ডলার), নেদারল্যান্ডস (৬০ হাজার ৩০০ ডলার), আইসল্যান্ড (৫৭ হাজার ডলার), সুইডেন (৫৬ হাজার ডলার), ডেনমার্ক (৫৫ হাজার ৭০০ ডলার) এবং জার্মানি (৫৫ হাজার ৩০০ ডলার)।

আমেরিকা: যুক্তরাষ্ট্র (৬৭ হাজার ৪০০ ডলার), কানাডা (৫২ হাজার ১০০ ডলার), পুয়ের্তো রিকো (৪১ হাজার ২০০ ডলার), অরুবা (৪১ হাজার ২০০ ডলার), ত্রিনিদাদ ও টোবাগো (৩৩ হাজার ৭০০ ডলার), দা বাহামাস (৩৩ হাজার ৪০০ ডলার), সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস (৩১ হাজার ৯০০ ডলার), অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুদা (৩০ হাজার ৬০০ ডলার), পানামা ২৮ হাজার ৫০০) এবং চিলি (২৭ হাজার ২০০ ডলার)।

আফ্রিকা: সিসিলিস (৩৩ হাজার ১০০ ডলার), মরিশাস (২৬ হাজার ৫০০ ডলার), ইকুয়েটোরিয়া গায়ানা (২০ হাজার ডলার), গ্যাবন (১৯ হাজার ৮০০ ডলার), বতসোয়ানা (১৯ হাজার ১০০ ডলার), আলজেরিয়া (১৬ হাজার ১০০ ডলার), মিসর (১৪ হাজার ৮০০ ডলার), দক্ষিণ আফ্রিকা (১৪ হাজার ডলার), তিউনিসিয়া (১৩ হাজার ১০০ ডলার) ও নামিবিয়া (১১ হাজার ৫০০ ডলার)।

এ তো গেল ধনী দেশের হিসাব। এবার দেখা যাক গরিব দেশ কারা।

সবচেয়ে গরিব: বুরুন্ডি (৭২৭ ডলার), সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (৮২৩ ডলার), কঙ্গো (৮৪৯ ডলার), ইরিত্রিয়া (১০৬০ ডলার), নাইজার (১১০৬ ডলার), মালায়ি (১২৪০ ডলার), মোজাম্বিক (১৩০৩ ডলার), দক্ষিণ সুদান (১৬০২ ডলার) ও সিয়েরা লিওন (১৬৯০)।

বাংলাদেশ তাহলে কোথায়

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ২০১৯ সালে তৈরি আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী। বাংলাদেশের অবস্থান ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৪৩তম। তাদের হিসাবে বাংলাদেশের পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি ৫ হাজার ২৮ ডলার। এবার দেখা যাক অন্য দেশগুলোর অবস্থান। ৬৬তম মালদ্বীপ (২৩ হাজার ৩১২ ডলার), ৯৯তম শ্রীলঙ্কা (১৩ হাজার ৮৯৭ ডলার), ১১২তম ভুটান (৯৮৭৬ ডলার), ১২৪তম ভারত (৮৩৭৮ ডলার), ১৩৪তম মিয়ানমার (৬৭০৭ ডলার), ১৩৮তম পাকিস্তান (৫৮৭২ ডলার), ১৬২তম নেপাল (৩৩১৮ ডলার) ও ১৭৬তম আফগানিস্তান (২০৯৫ ডলার)।