বিসিকে বড়দের ভিড়ে ছোটরা উধাও

বিসিক মানেই যেন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ভরপুর এলাকা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিসিকে দিন দিন বড় শিল্প বাড়ছে, কমছে ছোট কারখানা।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। সম্প্রতি এক দুপুরে সংস্থাটির ঢাকার মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ের দোতলা ও তিনতলায় ঢুঁ মারতেই দেখা গেল, সাবেকি কায়দায় পুরোনো টেবিল-আলমারিগুলো ফাইলের স্তূপে ভরে আছে। ধুলাবালি জমেছে ফাইলের ওপর। আলোর স্বল্পতায় স্যাঁতসেঁতে ভাব লক্ষণীয়। এ রকম এক অস্বাস্থ্যকর ও দৃষ্টিকটু পরিবেশেই কাজ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেখলেই মনে হবে, টাইম মেশিনে চড়ে আপনি তিন-চার দশক আগের কোনো সরকারি অফিসে ঢুকে পড়েছেন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার ছয় দশক পরও সরকারি সংস্থাটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।

দোতলায় সিঁড়ির পাশে একটি রুমে দুপুরের খাবারের পর কয়েকজনের আড্ডাবাজি চলছে। অনেকে কাজের মধ্যে থাকলেও তা ঢিলেঢালাভাবেই করছিলেন। অথচ ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বিসিকের প্রধান কার্যালয়টির আরও অনেক আধুনিক ও কর্মচঞ্চল হওয়ার কথা ছিল।

জানা গেছে, বিসিক এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি শিল্প প্লট দিয়েছে উদ্যোক্তাদের, যার অধিকাংশই এত দিনে বড়দের দখলে চলে গেছে। আর ছোটরা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারপারসন এবং এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাশেম খান প্রথম আলোকে বলেন, বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ছোটদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। একটি দেশে যেমন বড় শিল্প দরকার, তেমনি ছোট উদ্যোক্তাও দরকার। বড়দের পশ্চাৎপদ সংযোগ শিল্প হিসেবে ছোটরা কাজ করে। কোনো বিসিকেই ছোটদের বঞ্চিত করে বড়দের প্লট দেওয়া ঠিক নয়।

যাত্রা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান

সারা দেশে ছোট উদ্যোক্তা তৈরি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে এগিয়ে নিতে ১৯৫৭ সালে বিসিকের জন্ম হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রম, বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে আইন পরিষদে ইপসিক বিল এনেছিলেন। এটিই এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোক্তা তৈরির প্রথম উদ্যোগ। স্বাধীনতার পরে ইপসিকের নাম বদলে রাখা হয় বিসিক। বর্তমানে এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, এ সংস্থার শিল্পনগরগুলোতে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ৬৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের।

আড়াই দশক ঘুমিয়ে থাকা

দীর্ঘদিন ধরে বিসিক পুরোনো কাঠামো দিয়েই ঢিমেতালে চলেছে। ১৯৯০ সালের পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিসিকে কোনো জনবল নিয়োগ হয়নি। আড়াই দশক পর ২০১৫ সালে প্রথম বিসিকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পরে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে আরও দুটি নিয়োগ হয়। দুই দফায় ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো পদ খালি আছে ৮১৯টি। বর্তমানে বিসিকের ১৭৮টি কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ১ হাজার ৫৯১ জন।

খালি প্লট সাড়ে পাঁচ শ

বর্তমানে বিসিকের ৭৯টি শিল্পনগরে জমির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার একর। এসব শিল্পনগরে প্লটের সংখ্যা ১০ হাজার ৯২২। এর মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৯টি। বর্তমানে খালি আছে ৫৩৪টি প্লট।

তবে ১০ হাজারের বেশি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে ৫ হাজার ৮৮৫টি। অনেক উদ্যোক্তা একাধিক প্লট নিয়ে একটি বড় কারখানা করায় সংখ্যা কমেছে। চালু হওয়া শিল্পকারখানাগুলোর মধ্যে রগ্ণ বা বন্ধ হয়েছে ৭০৩টি। বাকি ৪ হাজার ৫৭০টি কারখানা এখন চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৯০১টি কারখানা রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন করে।

বড়রা বাড়ন্ত, ছোটরা ছুটন্ত

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্যই মূলত বিসিকের জন্ম হয়। লক্ষ্য ছিল, ছোট ছোট উদ্যোক্তারা বিসিকের এক-দুটি প্লট নিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন। পরে ব্যবসা ভালো হলে আস্তে আস্তে মাঝারি ও বড় শিল্প গড়বেন।

কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ছোটরা নিজেদের ব্যর্থতার পাশাপাশি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো প্লট নেওয়ার কারণে বিসিক শিল্পনগর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বড়দের প্লটের পর প্লট নেওয়ার কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। হোসিয়ারি শিল্পের জন্য ১৯৯০ সালে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী এলাকায় ৫৮ একর জমির ওপর বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়। এতে মোট প্লট ৭২৯টি। কিন্তু সেখানকার প্রায় ১৯ শতাংশ প্লটই মাত্র তিনটি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের ফকির অ্যাপারেলসের হাতে আছে ৫৫টি শিল্প প্লট। এ ছাড়া এম এস ডায়িং প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিংয়ের ৪৪টি ও ফেয়ার অ্যাপারেলসের ৩৮টি প্লট আছে। সব মিলিয়ে এ তিন প্রতিষ্ঠানের হাতে আছে ১৩৭টি প্লট।

অন্যান্য বিসিক শিল্পনগরেও এমন চিত্র দেখা যায়। যেমন গ্লোব শিল্পগোষ্ঠী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ; হ্যামকো ব্যাটারি খুলনা; বিআরবি কেব্‌লস কুষ্টিয়ায় বিসিক শিল্পনগরীর সিংহভাগ প্লট নিয়ে বসে আছে। আবার চট্টগ্রাম কালুরঘাট বিসিকে ওয়েল গ্রুপ কয়েকটি প্লট নিয়ে কারখানা স্থাপন করেছিল। পরে আশপাশের খালি প্লট কিনে নেয় গ্রুপটি। অবশ্য বিসিকে ওয়েল গ্রুপের চার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার কর্মী কাজ করেন।

এ বিষয়ে বিসিকের চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ছোট প্লটের চাহিদা নেই। ছোট উদ্যোক্তারা প্লট নিলেও বিনিয়োগের সামর্থ্য নেই। তাঁদের প্লট খালি পড়ে থাকে কিংবা বড়দের কাছে বিক্রি করে দেন তাঁরা।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাহিদা নেই

উদ্যোক্তারা পার্বত্য, হাওর এলাকাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিসিকে প্লট নিতে আগ্রহ দেখান না। সেগুলো বছরের পর বছর প্লট খালি পড়ে থাকে। কারণ, ওই সব জায়গায় পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করা কঠিন। তাই বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও উদ্যোক্তা ক্রেতা মেলে না।

খাগড়াছড়ি বিসিকে প্লটের সংখ্যা ৭১টি। এর মধ্যে ৩৮টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে চালু আছে মাত্র একটি কারখানা। অন্যদের কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ কারখানা করতে এখন আর আগ্রহী নন। আবার রাঙামাটি বিসিকে ৮৫টি প্লটের মধ্যে ৭২টি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন চালু আছে ১০টি কারখানা। বাকিরা প্লট নিলেও কারখানা করেননি।

খাগড়াছড়ি বিসিকে ৩৩টি ও রাঙামাটি বিসিকে ১৩টি প্লট দীর্ঘদিন দিন ধরে খালি পড়ে আছে। গত বছরের জানুয়ারি ও আগস্ট মাসে দুবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও ক্রেতা মেলেনি। একইভাবে গত দুই বছরে সুনামগঞ্জ বিসিকে মাত্র ১৫টি প্লট বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।

এক উদ্যোক্তাই চান ৪৫টি প্লট!

রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের আশপাশেই মূলত প্লটের চাহিদা বেশি। এসব জায়গায় উদ্যোক্তারা একটি নয়, একাধিক প্লট চান। যেমন গত বছরের আগস্টে ঢাকার পার্শ্ববর্তী ধামরাই বিসিক শিল্পনগরে ৬১টি প্লটের জন্য আবেদনপত্র চাওয়া হয়। মাত্র দেড় মাস সময় দেওয়া হয়। সেখানকার প্লটের জন্য আবেদন করেন সাড়ে তিন শতাধিক উদ্যোক্তা। প্রতিটি প্লটের বিপরীতে গড়ে ছয়টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে। বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, একটি বড় শিল্পগোষ্ঠী একাই ৪৫টি প্লটের জন্য আবেদন করেছে। কয়েক মাসে আগে চট্টগ্রামের মিরসরাই শিল্পনগরের ৭৪টি প্লটের সবই দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়।

পুরোটাই চায় চীনা কোম্পানি

আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রস্তুত হচ্ছে সিরাজগঞ্জ বিসিক। সেখানে ৪০০ একর জমিই নিতে চায় একটি চীনা কোম্পানি। কিন্তু বিসিক কর্তৃপক্ষ রাজি নয়। তারা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অর্ধেক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাকি অর্ধেক প্লট বরাদ্দ দিতে চায়।

বিসিকে সফল যাঁরা

সাধারণত বিসিকের কথা শুনলেই চোখের সামনে কিছু ছোট ও কুটিরশিল্প কারখানার চিত্রই ভেসে ওঠে। কিন্তু বিসিক থেকে অনেক নামজাদা শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে, যারা দেশে–বিদেশে নাম কুড়িয়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, যেটি ১৯৮৯ সালে পাবনা বিসিক শিল্পনগরে স্থাপিত হয়েছিল। একসময়ের জনপ্রিয় ন্যাশনাল ফ্যানের সুখ্যাতি ছড়ায় টঙ্গী বিসিক থেকে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। এ সময়ের দারুণ সফল ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড আরএফএলের যাত্রা শুরু হয়েছিল রংপুর বিসিক শিল্পনগর থেকে।

একইভাবে ১৯৮০ সালে বরিশাল বিসিক থেকে পথচলা শুরু করেছিল দেশের প্রথম প্রজন্মের বিস্কুট কারখানা বেঙ্গল বিস্কুট। এ ছাড়া বিসিক শিল্পনগরের নামজাদা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাহাজ মার্কা আলকাতরা, মেরিডিয়ান চিপস, হ্যামকো ব্যাটারি, বিআরবি কেব্‌লস, কৃষি যন্ত্রপাতির কারখানা বগুড়ার উত্তরা এজেন্সি অটোমোবাইল, গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বগুড়া মটরস ইত্যাদি।