বেজোস-মাস্ক, এগিয়ে কে?

এ বিশ্ব যেন সব সময় নতুনত্ব চায়। বিশ্বের মঞ্চে একটানা ধারায় এগিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টি, নতুন উদ্যোগ, নতুন ভাবনা। একসময় মনে হতো, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে কে হটাবেন শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকে? তবে সেটাও একসময় ঘটে যায় জেফ বেজোসের মতো নতুন উদ্ভাবকের হাত ধরে। আবার কয়েক বছরের মধ্যে বেজোসকে হটানোর জন্য ইলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তাও চলে আসেন।

সম্প্রতি ফোর্বস–এর ৩৫তম বার্ষিক বিলিয়নিয়ারের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। তালিকায় টানা চতুর্থবারের মতো শীর্ষে রয়েছেন মার্কিন ধনকুবের জেফ বেজোস। আমাজনের মালিক বেজোসের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭৭ বিলিয়ন ডলার। আর বেজোসের পর বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। টেসলা ও স্পেসএক্সের মালিক মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ১৫১ বিলিয়ন ডলার।

গত ছয় বছরে এই ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধির ধারাটা লক্ষ করলে মজার কিছু বিষয় উঠে আসে। দেখা যায়, ২০২০ সাল পর্যন্ত বেজোসের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলেন মাস্ক। মাস্কের বড় উত্থানটা হয়েছে এ বছর। জানুয়ারিতে যখন বেজোসকে পেছনে ফেলেন মাস্ক, বিষয়টা যেন তাঁর জন্যও অন্য রকম ছিল। টুইটারে এক ব্যবহারকারী মাস্ককে এ খবর জানানোর পর প্রতিক্রিয়ায় মাস্ক লিখেছিলেন, ‘কী অদ্ভুত’।

শুরুটা করি ২০১৫ সাল দিয়ে। ওই বছর বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ইলন মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। সে বছর তাঁর ২০ বছরের ব্যবসায়ে বেশ কিছু মোড় ঘুরানো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেজোস। আমাজনে প্রাইম ডে চালু করেন। ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হাজার হাজার পণ্য নিয়ে ‘প্রাইম ডে’ হলো আমাজনের একটি বিশেষ বিক্রয় ইভেন্ট, যাতে বিভিন্ন পণ্যে ব্যাপক ছাড় থাকে। এ ছাড়া ওই বছরই ব্লু অরিজিন নামে একটি মহাকাশ অভিযান প্রতিষ্ঠা করেন বেজোস।

জেফ বেজোস

অন্যদিকে ওই বছর মাস্কের বড় সাফল্য ছিল তাঁর মহাকাশ সংস্থা স্পেস এক্স দিয়ে। এর আগপর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান নির্বাহী হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন ইলন। স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস (স্পেস এক্স) কোম্পানি ওই বছর ‘ফ্যালকন ৯’ নামের একটি রকেটের সফল অবতরণ করায়।

২০১৬ সালে এসে নতুন মোড়। এ বছর বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে মাস্কের সম্পদের পরিমাণ কমে যায়। আসলে অসাধারণ এই উদ্যোক্তা বরাবরই বেজোসের তুলনায় একটু খেয়ালি, অভিযানপ্রিয়। তাই ২০১৬ সালে যেখানে বেজোস নিজের মালিকানাধীন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টকে মুনাফার মুখ দেখান, সেখানে মাস্কের টেসলা ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে সৌরচালিত সিস্টেম সরবরাহকারী সোলারসিটি কিনে নেন। এটি তেমন লাভজনক কিছু ছিল না। ওই বছরই বেজোস স্টারটেক বিয়ন্ড সিনেমার জন্য ক্যামিও বানান, অন্যদিকে বাজারে নতুন মডেলের সাশ্রয়ী (৩৫ হাজার ডলার) বৈদ্যুতিক গাড়ি আনে টেসলা।

চলে এল ২০১৭ সাল। তরতর করে এগিয়ে চলছে বেজোসের আমাজন। এ বছরই মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে সরিয়ে ৭২ দশমিক ৮ বিলিয়ন সম্পদ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর জায়গা নিয়ে নেন বেজোস। বিল গেটস যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ৪০০ ধনীর শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলেন টানা ২৪ বছর ধরে। সে আসনে বসে পড়েন বেজোস। অন্যদিকে স্পেস এক্স নিয়েই সব উৎসাহ ছিল ইলনের। আবার ফ্যালকন ৯ রকেট এবং ড্রাগন স্পেস ক্র্যাফট ব্যবহার করে স্পেস এক্স। এ বছর ইলনের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।

ইলন মাস্ক

২০১৮ সালে এই দুই ধনকুবেরের সম্পদের ব্যবধান ছিল, ৯২ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১২ বিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে মাস্কের ছিল সে তুলনায় মাত্র ১৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। নিজের কোম্পানির কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে দিয়েও শীর্ষ ধনীর জায়গা অটুট বেজোসের, অন্যদিকে খামখেয়ালি ধনী ইলনের চলছে মহাকাশ সাধনা। ২০১৯ সালে এসে দুই ধনীর সম্পদের ব্যবধান বেড়ে গেল ১০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে এ বছর ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে বিচ্ছেদ টানেন বেজোস। সেই বিচ্ছেদের ব্যয় শুনলেও চোখ কপালে উঠবে। চুক্তি অনুযায়ী আমাজনের ৩৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ার পান তাঁর স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি। তবে বিচ্ছেদের বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই সামলে নেন বোজোস। এ বছর কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তিনি। অন্যদিকে টেসলা আনতে থাকে নতুন নতুন মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি।

২০২০ সালে করোনার মহামারির সূচনা হয়। এ বছরের শুরুতে টালমাটাল অবস্থায় থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যে সামলে নিয়ে ইলন মাস্ক বেশ গুছিয়ে এগোতে থাকেন। বাজার মূলধনের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান গাড়ি সংস্থা হয়ে ওঠে টেসলা। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসের অস্টিনে চলে আসেন ইলন, সেখানে টেসলা একটি নতুন গিগাফ্যাক্টরি তৈরির ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে করোনার প্রভাব পড়েনি বেজোসের সম্পদেও।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমাজনের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বেজোস। তবে এর পরেও যেন সাফল্যের শেষ নেই তার। এ বছর বেজোসের আমাজন স্টুডিওর বোরাট সাবসিকোয়েন্ট মুভি ফিল্ম অস্কারে ১২টি পুরস্কারের জন্য নমিনেশন পেয়েছে। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে স্পেসএক্সের মূল্য বেড়েছে ৭৪ বিলিয়ন ডলার।

গত বছর বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হন বেজোস। করোনার কারণে প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা অনলাইনের কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় ফুলে–ফেঁপে ওঠে বেজোসের ব্যবসা। তবে বছরের শেষটা ছিল পুরোপুরি ইলনের হাতে। ডিসেম্বরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় টেসলা। এর শেয়ারদর বাড়ে ৭২০ শতাংশ।

২০২১ সালে ইলনের সম্পদ বৃদ্ধিটা যেন অবিশ্বাস্য। গত বছরের ২৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ইলনের সম্পদের পরিমাণ হয় ১৫১ বিলিয়ন ডলার। বছরের শুরুতে একবার বেজোসকে শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকে পেছনেও ফেলে দেন মাস্ক।