ব্যাটারির বাজারে দেশীয় সাফল্য

বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বাস্তবতা হলো, বেড়ে চলেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। কায়িক শ্রম কমাতে ব্যাটারির চাহিদা বাড়ছে এখন ত্রিচক্রযানেও। ক্রমবর্ধমান মোটরগাড়ির চাহিদা তো রয়েছেই। আবার গত কয়েক বছরে দেশে দ্রুত বেড়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। তাতেও বেড়েছে ব্যাটারির চাহিদা।
এভাবে চাহিদার বিস্তৃতি বড় করে তুলেছে দেশের ব্যাটারির বাজার। আর চাহিদা মেটাতে এই বাজারে প্রবেশ করেছে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফলে সব ধরনের মোটরগাড়ি, মোটরসাইকেল, আইপিএস, সোলার প্যানেলসহ বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য ব্যাটারি উৎপাদন করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর ব্যাটারি উৎপাদনে দেশে একটিমাত্র কারখানা ছিল। চার দশক পর এটি এখন শিল্প খাত হিসেবে বিস্তৃত হচ্ছে। তবে সম্ভাবনা থাকলেও সরকারের সুনজরের অভাবে এলোমেলোভাবে এই শিল্পটির বিকাশ হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁরা জানান, নীতি-সহায়তা পেলে দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে এই খাত। রপ্তানির বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এই শিল্পটি যেন পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য যথাযথ উদ্যোগও দরকার।
দেশে ড্রাইসেল ও লিড অ্যাসিড—এই দুই ধরনের ব্যাটারি তৈরি হয়। পেনসিল ব্যাটারি হিসেবে বহুল পরিচিত পণ্যটিই ড্রাইসেল ব্যাটারি। তবে ড্রাইসেল ও লিড অ্যাসিড ব্যাটারি, দুটি আলাদা শিল্প। আর এই প্রতিবেদনটি মূলত লিড অ্যাসিড ব্যাটারি নিয়েই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে লিড অ্যাসিড ব্যাটারির বার্ষিক বাজার এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দুই ধরনের লিড অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরি করে থাকে—অটোমেটিভ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিপ সাইকেল। এ ছাড়া মোবাইল ফোন টাওয়ারের জন্য ব্যবহূত ভালভ রেগুলেটেড লিড অ্যাসিড (ভিআরএলএ) ব্যাটারির বড় বাজার আছে। এই ব্যাটারি তৈরিতে কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকলেও এখনো বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে আমদানীকৃত ব্যাটারি। কারণ, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো বিদেশি ব্যাটারিই সংগ্রহ করে থাকে।
বাংলাদেশ অ্যাকিউমুলেটর অ্যান্ড ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিএমএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বছরে ১৮ লাখের বেশি ব্যাটারি প্রস্তুত হয়। এর মধ্যে গাড়ি ও মোটরসাইকেলে ব্যবহূত অটোমেটিভ ব্যাটারি পাঁচ লাখ ৯০ হাজার, আইপিএস ও ইউপিএসের ব্যাটারি চার লাখ ৩৭ হাজার, জেনারেটর ও ভারী যন্ত্রপাতিতে ব্যবহূত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাটারি এক লাখ এবং সোলার প্যানেলের ব্যাটারি সাত লাখ। এ ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত অটোমেটিভ ব্যাটারি বিশ্বের ৫৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ পিস ব্যাটারি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে যার প্রায় পুরোটাই করছে রহিমআফরোজ।
বিএবিএমএর হিসাব অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০টি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সমিতির সদস্য ১২। এ খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রহিমআফরোজ। গ্লোবাট, লুকাস ও স্পার্ক ব্র্যান্ড নামে ব্যাটারি বাজারজাত করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া হ্যামকো, নাভানা ব্যাটারি, র্যাংগস, পান্না গ্রুপ, রিমসো ব্যাটারি অ্যান্ড কোম্পানি বর্তমানে লিড অ্যাসিড ব্যাটারির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের লিড অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরির কাঁচামালের ৫০ শতাংশই কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন থেকে আমদানি করতে হয়। তবে বাকি কাঁচামাল দেশেই পুনরুৎপাদনের (রিসাইক্লিং) মাধ্যমে পাওয়া যায়।
বিএবিএমএর সভাপতি ও রহিমআফরোজ গ্রুপের পরিচালক মুনওয়ার মিসবাহ মঈন প্রথম আলোকে জানান, প্রতিবছর ব্যাটারির চাহিদা বাড়ছে অটোমেটিভে ১০ শতাংশ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিপ সাইকেলে ১৫ শতাংশ হারে।
১৯৫৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের লুকাস ব্যাটারি দেশে বাজারজাতকরণের কাজটি করত রহিমআফরোজ। সে সময় রাজধানীর নাখালপাড়ায় লুকাসের নিজস্ব কারাখানা ছিল। স্বাধীনতার পর লুকাস এ দেশ থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। আর লুকাসের কারখানাসহ ব্যাটারির বাজারটি হাতবদল হয়ে রহিমআফরোজের কাছে চলে আসে। ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যাটারির বাজারে এককভাবে নেতৃত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০০ সালের পর বড় আকারে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় হ্যামকো, নাভানা, র্যাংগস, পান্না গ্রুপের মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ খাতে প্রায় ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
নাভানা ব্যাটারির করপোরেট ম্যানেজার মজিবুল হক বলেন, রহিমআফরোজ ও হ্যামকোর পর বড় আকারে উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে ব্যাটারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় নাভানা।
আবার ১৯৮০ সালের দিকে পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ছোট্ট পরিসরে ব্যাটারির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করে পান্না ব্যাটারি লিমিটেড। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি ‘ভলভো’ ব্র্যান্ড নামে সম্পূর্ণ তৈরি ব্যাটারি বাজারজাত শুরু করে।
নীতিসহায়তায় পাল্টাবে চিত্র: মুনওয়ার মিসবাহ মঈন বলেন, ‘ব্যাটারি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে অ্যাসিডের ব্যবহার হয়। আবার উৎপাদন পর্যায় ও ব্যবহারের পর ব্যাটারি যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের জন্য তা হুমকিও তৈরি করছে। দেশে যে পরিমাণ ব্যাটারি ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়, তার ৫০ শতাংশ আমরা পুনঃ ব্যবহারযোগ্য বা রিসাইক্লিং করতে পারি। তাই পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে এ ক্ষেত্রে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
পান্না ব্যাটারির উপব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ড) জ্ঞানদীপ ঘোষ বলেন, ‘আমরা অটোমেটিক, আইপিএস, সোলার ও মোটরসাইকেল ব্যাটারি তৈরি করি। অটো বা ইজিবাইক ও টাওয়ারের জন্য ব্যবহূত ব্যাটারি তৈরির সক্ষমতাও আমাদের আছে। বর্তমানে এগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয়। সরকার এই বিষয়টিতে নজর দিলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব।’
২৮,২৭,৫০০ পিস লিড অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরি করে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো
অটোমেটিভ ৫,৯০,০০০
(সব ধরনের গাড়িতে ব্যবহূত হয়)
আইপিএস ৪,৩৭,৫০০
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ১,০০,০০০
সোলার ৭,০০,০০০
১০ লাখ ব্যাটারি ৫৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্রতিবছর
“ব্যক্তি খাতের একক প্রচেষ্টায় ব্যাটারির বাজার বড় হয়ে উঠেছে। তাই এটিকে এখন শিল্প বিবেচনায় নিয়ে শিল্পসম্মত বিকাশে সরকারি সহায়তা দরকার। পাশাপাশি পরিবেশদূষণ রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
মুনওয়ার মিসবাহ মঈন
সভাপতি, বিএবিএমএ
সূত্র: বিএবিএমএ