ব্র্যান্ডের জুতার বিক্রিতে হতাশা, ননব্র্যান্ডে মন্দের ভালো

বাটা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা
ছবি: হাসান রাজা

ঢাকার নিউমার্কেটের বিভিন্ন জুতার দোকানে ঘুরছিল সাদিক ও রুহুল, এক জোড়া কেডস কেনার আশায়। দুজনই শ্রমজীবী কিশোর। বিভিন্ন দোকান ঘুরে নানা রঙ ও বৈচিত্র্যের জুতা দেখছিল। দরদামে মিলছিল না। দুজনেরই জুতা কেনার বাজেট ৫০০ টাকা করে এক হাজার টাকা। পকেটে নয়, হাতের মুঠোয় সেই টাকা নিয়ে ঘুরছিল তারা।
নিউমার্কেটে গতকাল বুধবার যখন তাদের সঙ্গে দেখা হয়, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঈদের বাজারে সাদিক ও রুহুলের নতুন জুতার শখ পূরণ হবে কি? তা জানতে পিছু নিলাম তাদের। কয়েকটি দোকান ঘুরে এক দোকানে গিয়ে হলুদ রঙের এক জোড়া কেডস পছন্দ হয় রহুলের। শেষ পর্যন্ত দরদামেও মিলে যায়। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম পায়ের চেয়ে বড় মাপের এক জোড়া জুতা কিনে বেজায় খুশি রহুল। তখনো সাদিকের কেনা হয়নি শখের জুতা। দোকান থেকে বেরিয়ে আসতেই আবারও মুখোমুখি আমরা। রহুলের কাছে জানতে চাইলাম পায়ের মাপের চেয়ে বড় জুতা কিনলে কেন? জবাবে রুহুল বলেন, গত বছর ঈদের জুতা কেনার টাকা ছিল না। এ বছর কিছু টাকা পেয়েছি। তাই পছন্দের এ জুতা কিনতে পারলাম। সামনের বছর যদি কেনার সামর্থ্য না থাকে, তাই একটু বড় সাইজের কিনলাম। এতটুকু বলে চলে গেল তারা।

এবার সাদিক ও রুহুলকে ছেড়ে গেলাম কয়েকটি জুতার দোকানে। দোকানিরা জানালেন, গত বছরের ঈদের চেয়ে এবারের বেচাকেনা একটু ভালো। এটুকু বেচাকেনা না হলে তাঁদের ব্যবসায় টিকে থাকা মুশকিল হতো। করোনার কারণে গত বছর ঈদে মার্কেটে তেমন ক্রেতা ছিল না। এবারও আছে করোনার ভয়, সরকারি বিধিনিষেধ। তবু মানুষ ঈদের কেনাকাটা করতে ঘর থেকে বেরিয়েছে। তাতেই কিছু স্বস্তি দোকানিদের। সরকারও ঈদের কেনাবেচার সুবিধার্থে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গত ২৫ এপ্রিল থেকে দোকানপাট ও মার্কেট খুলে দিয়েছে।

সাদিক ও রহুলের মতো ঈদ কেনাকাটার অন্যতম অনুষঙ্গ জুতা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার বেচাবিক্রি কমবেশি যা–ই হোক, জুতার দোকানে ক্রেতারা ভিড় করছেন। ক্রেতার ভিড়ই আশাবাদী করছে দোকানিদের। তাই শেষ মুহূর্তে লাভ-লোকসানের হিসাব করার চেয়ে জমে থাকা কিছু পণ্য বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পেতে মরিয়া দোকানিরা।

নিউমার্কেটের অদূরেই এলিফ্যান্ট রোড এলাকা জুতার জন্য বিখ্যাত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই সেখানে গিয়ে দেখা গেল ক্রেতা-বিক্রেতারা ব্যস্ত যাঁর যাঁর কাজে।

এলিফ্যান্ট রোডের গফুর ম্যানশনের সামনের ফুটপাতে একটা ছোট কাঠের চৌকিতে জুতা সাজিয়ে বিক্রি করছিলেন বাদশা মিয়া। তাঁর চৌকির দোকানেও বিক্রয়কর্মীর সংখ্যা সাত। সবাই ব্যস্ত ঈদের বিক্রি নিয়ে। বিক্রি কেমন যাচ্ছে প্রশ্ন করতেই বাদশা মিয়া বলেন, ‘ভালোই। গত বছর কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। এ বছর দিনে ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকার বিক্রি হচ্ছে। যদিও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এ বিক্রি প্রায় অর্ধেক। তারপরও করোনার এ সময়ে এই বিক্রিতে খুশি আমি। হাতে কিছু নগদ টাকার খুব দরকার।’

বাদশা মিয়াসহ এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেটের বেশ কয়েকজন জুতা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরে জুতার বাজারের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে ননব্র্যান্ডের জুতার চাহিদা। এ কারণে সাদিক-রহুলের মতো শ্রমজীবী কিশোরেরা হাতের মুঠোয় ৫০০ টাকা নিয়ে ছোটে ননব্র্যান্ডের দোকানে ঈদে শখের জুতা কিনতে।

ননব্র্যান্ডের জুতার বিক্রি ছোট ব্যবসায়ীদের কিছুটা রসদ জোগালেও খুব বেশি বিক্রি নেই ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোয়। দেশীয় ব্র্যান্ড অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালের স্বাভাবিক সময়ে ঈদে যত বিক্রি হয়েছিল, এবারের ঈদের বিক্রি তার মাত্র ৩০ শতাংশ। আর নানাভাবে প্রচার চালিয়ে ও প্রস্তুতির পরও আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি জুতার বাজারের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড বাটা। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মালিক মেহেদী কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আউটলেটগুলোয় ক্রেতার আনাগোনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ কমে গেছে।। এ কারণ বিক্রি খুব বেশি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না।’

করোনার কারণে ব্র্যান্ড ও ননব্র্যান্ডের জুতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাই অনলাইনে বিক্রিতে বাড়তি নজর দিয়েছেন। ক্রেতারাও ঝুঁকিমুক্ত থাকতে অনলাইন কেনাকাটায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গত এক বছরে তাই ই-কমার্স ব্যবসা বা অনলাইনে পণ্য বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। যদিও বিক্রেতারা বলছেন, অনলাইনে বিক্রির পরিমাণ এখনো মোট বিক্রির ৫ থেকে ৭ শতাংশ।

লা মোড নামে নারীদের জুতার দেশীয় নতুন একটি ব্র্যান্ড এ ঈদে তাদের বেশির ভাগ পণ্যই বিক্রি করেছে অনলাইনে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ফাহমিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনও গেছে, একেকটি আউটলেটে একজন ক্রেতাও আসেনি, কিন্তু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে পুরোদমে।’ এই বিক্রি থেকে প্রত্যাশিত আয় করতে না পারলেও তাতেই খুশি ফাহমিদা। কারণ, গত বছরের মতো দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে না এবার।