বড় অনিয়মের অভিযোগ উত্তরা ফাইন্যান্সে

অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ ও ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে।

বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসের বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এ কেলেঙ্কারি বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ঋণ বের করে নিয়েছেন। আবার ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) গাড়ি-বাড়ি কিনতে অনুমোদন ছাড়া ঋণ নিয়েছেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু লেনদেনের নথিপত্রও খুঁজে পায়নি, তাই সেসব লেনদেন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। ভালো মানের এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতেও এ ধরনের ঘটনায় পুরো খাতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ ও ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা তদন্তে পাওয়া আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জবাব দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। সেখানে উত্তরা ফাইন্যান্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, করোনায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তার (সিএফও) হঠাৎ মৃত্যুর কারণে কিছু লেনদেনের নথিপত্র খুঁজে পেতে সমস্যা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেগুলো খুঁজে বের করে জমা দেওয়া হয়েছে।

এমনিতেই দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আবার প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের কারণে নতুন করে সমস্যায় পড়েছে আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এখন উত্তরা ফাইন্যান্সের নানা কেলেঙ্কারি সামনে এল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তরা ফাইন্যান্সের আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া গেছে। আর্থিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি যেসব তথ্য দিয়েছে, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায়নি। এর বাইরে আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে। এ নিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম। তাদের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

উত্তরা ফাইন্যান্সের আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের গরমিল পাওয়া গেছে। আর্থিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি যেসব তথ্য দিয়েছে, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায়নি।
সিরাজুল ইসলাম নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক

উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারের মার্জিন ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা জমা হয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্সের বিভিন্ন পরিচালকের ব্যাংক হিসাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের আবেদন, প্রস্তাব বা অনুমোদন ছাড়া পরিচালকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে ৩১১ কোটি টাকা।

২০১৯ সাল শেষে অগ্রিম ও আগে পরিশোধ খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ৭৯৯ কোটি টাকা। কারা অগ্রিম এত টাকা নিয়েছেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার উত্তরা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসান প্রাপ্যতার বাইরে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে উত্তরা ফাইন্যান্স জানিয়েছে, এ–সংক্রান্ত ব্যাখ্যা তারা সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দিয়েছে। সেখানে নথিপত্রও উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা উত্তরা ফাইন্যান্স পরিদর্শনে দেখেছেন, প্রতিষ্ঠানটির এমডি এস এম শামসুল আরেফিন কোনো অনুমোদন ছাড়াই ব্যবস্থাপনা ব্যয় শিরোনামে ২৪ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে এমডির পক্ষে সাউথ ব্রিজ হাউজিংকে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, বে ডেভেলপমেন্টকে ১ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে ডিএইচএসকে ৫০ লাখ টাকা ও উত্তরা মোটরসকে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এমডির টাকা উত্তোলনে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না। এর বাইরে উত্তরা মোটরস ও উত্তরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩৩৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যার কোনো অনুমোদন নেই। তবে উত্তরা ফাইন্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যে ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, আর্থিক সংকটে পড়ে তারল্যসংকট মেটাতে উত্তরা গ্রুপ থেকে কিছু টাকা ধার করতে হয়েছিল। পরে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।

আমাদের সিএফওর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে কিছু নথিপত্র খুঁজে পেতে ও দীর্ঘদিনের পুরোনো হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে মেলাতে পারিনি। এখন আমরা বেশির ভাগ নথিপত্র খুঁজে বের করেছি। সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাও দিয়েছি।
এস এম শামসুল আরেফিন, এমডি, উত্তরা ফাইন্যান্স

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমান ব্লু চিপস সিকিউরিটিজের কর্ণধার। এই প্রতিষ্ঠানের ২৩৬ কোটি টাকা আমানত জমা করা হয়েছে। তবে এর বিপরীতে কোনো বৈধ নথিপত্র সংরক্ষণ নেই। ফলে আদৌ এই টাকা জমা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। যদি কোনো ব্যাংক এই আমানতের বিপরীতে ঋণ দেয়, তার পুরো দায় উত্তরা ফাইন্যান্সের ওপর বর্তাবে।

উত্তরা ফাইন্যান্স নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারমর্ম টেনে প্রতিবেদনে বলেছে, ‘লেনদেনের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে উত্তরা ফাইন্যান্স আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা ফাইন্যান্সের এমডি এস এম শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিটি বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছি। আমাদের সিএফওর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে কিছু নথিপত্র খুঁজে পেতে ও দীর্ঘদিনের পুরোনো হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে মেলাতে পারিনি। এখন আমরা বেশির ভাগ নথি খুঁজে বের করেছি। সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাও দিয়েছি। যেহেতু বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনাধীন, তাই এ নিয়ে আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি।’

নিজের ঋণের বিষয়ে শামসুল আরেফিন বলেন, ‘গাড়ি কেনা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের জন্য, কিন্তু সেই বাবদ খরচ হওয়া অর্থ আমার ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট খরচের অনেক অর্থ আমার নামে দেখানো হয়েছে। সিএফও সাহেব এ ভুল করে রেখেছিলেন। সব মিলিয়ে এখন আমার কাছে প্রতিষ্ঠানের ঋণ মাত্র ৭৫ লাখ টাকা।’

উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোং। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের আপত্তি তোলেনি। সম্প্রতি এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকের নিরীক্ষা করার অনুমতিপত্র আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তবে সেটি অন্য কারণে।

নিরীক্ষকদের দায় নিয়ে জানতে চাইলে সনদধারী হিসাববিদ বা নিরীক্ষকদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি দেওয়ান নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরা ফাইন্যান্সে যা ঘটেছে, তা নিরীক্ষকদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এরপরও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো আপত্তি তোলেনি। হতে পারে এতে যোগসাজশ ও ব্যর্থতা ছিল। বাংলাদেশে নিরীক্ষকদের স্বাধীনতা আছে। তবে সবাই তা ধরে রাখতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে সময় কম দেওয়া হয়। এতে আর্থিক খাতের বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উত্তরা ফাইন্যান্সকে ১৯৯৫ সালে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ৩টি শাখা। ২০১৯ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা ও ঋণ ৩ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। আর একই বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ছিল ২ হাজার ৫৩৩ জন।