‘বড় প্যাকেজ, তাতে আমার লাভ কী’

২৩টি প্যাকেজে মোট ১,২৮,৪৪১ কোটি টাকা অনুমোদন।

১৩ মাসে ৮২,৬৩৮ কোটি টাকা বিতরণ বা ৬৪.৩% বাস্তবায়ন।

ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়া ১১ প্যাকেজে বরাদ্দ ১,০১,৯২০ কোটি টাকা।

বৃহৎ ও এসএমই খাতে এখনো ১৭,৭৩৬ কোটি টাকা বিতরণ হয়নি।

করোনাকালে ৪১% ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে।

দিনাজপুরে দুই বিঘা জমির ওপর আমার একটি পনির উৎপাদনের কারখানা আছে। করোনায় উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়েছিল, তেমনি পণ্যের চাহিদাও কমেছিল। এরপর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসায় চাহিদা আবার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তখন নগদ টাকার সংকটে পড়ি। ঋণের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে ছয় মাস দৌড়াই। নানা অজুহাতে তারা ঘুরিয়েছে। সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও ঋণ দেয়নি। শেষ পর্যন্ত একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) থেকে উচ্চ সুদে কয়েক লাখ টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছি। অথচ প্যাকেজের স্বল্প সুদের ঋণটা পেলাম না।’

কথাগুলো বললেন নাজনীন নাগিনা নামের ঢাকার মোহাম্মদপুরভিত্তিক একজন উদ্যোক্তা। গত শনিবার এই নারী উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমএফআইয়ের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে ১০ হাজার কোটি টাকার একটা তহবিল গঠনের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। সেটি চালু হয়ে গেলে ঝামেলা ছাড়াই ঋণ পেতাম।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান

নাজনীন নাগিনার মতো আরও অনেক উদ্যোক্তা ঋণের জন্য এখন বিভিন্ন ব্যাংকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। কিন্তু ঋণ মিলছে না।

করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বড়-ছোট সব উদ্যোক্তাই বিপদে। স্বল্প আয়ের মানুষ তো চরম দুর্দশায়। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার গত বছরের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত দুই ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এক ধরনের প্যাকেজ হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের, অন্যটি হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষার। কিন্তু অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ থেকে অনেকেই স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারলেও বড় একটা অংশ আবার পারছে না। কারণ, কিছু ব্যাংক বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে রাজি নয়।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত এপ্রিলে উদ্যোক্তাদের ওপর একটি সমীক্ষা করে। এতে দেখা যায়, করোনাকালে সৃষ্ট সংকটে নারী উদ্যোক্তাদের ৪১ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের নারী উদ্যোক্তাদের অন্তত ৭ দশমিক ১ শতাংশ ব্যবসা সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া মহামারিকালে প্রায় ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ভাড়া দিতে পারেননি।

সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কতটা কাজে লাগছে, তা নিয়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওই দিন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, ‘দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে টাকা যাচ্ছে না। কারণ, অধিকাংশ উদ্যোক্তার সঙ্গে ব্যাংকের কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা পারিবারিকভাবে ব্যবসা চালান, ব্যাংকে যান না। এসব উদ্যোক্তা ব্যাংকের আওতায় না এলে প্রণোদনা প্যাকেজ কোনো কাজে আসবে না।’

পরিকল্পনামন্ত্রীর এমন মন্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন প্যাকেজে। যেমন প্যাকেজটি চালুর ১৩ মাসের মাথায় গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৬টি ব্যাংক ও ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ৫ হাজার ৪০২ কোটি টাকা এখনো বিতরণ করতে পারেনি। অথচ অর্থ বিভাগের অনুমান ছিল, এ প্যাকেজের মাধ্যমে ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। সোনালী-রূপালীর বিতরণও ভালো নয়। বেসরকারি খাতে ব্র্যাক ব্যাংক ও সরকারি খাতে অগ্রণী ব্যাংক সবচেয়ে ভালো করেছে।

অন্যরা পারল না, অগ্রণী ব্যাংক কীভাবে পারল, তা জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ৮৪৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। জুনের মধ্যে দিতে চাই আরও ১০০ কোটি টাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঋণপ্রার্থী গ্রাহকদের দরকারি কাগজপত্রের জন্য সাবরেজিস্ট্রি অফিস খোলা থাকার দরকার ছিল। কিন্তু করোনার প্রকোপ ও লকডাউনের কারণে তা বন্ধ ছিল। আমরা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা নিয়ে ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। তার আগে আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়েছি।’

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সরকার ২৩টি প্যাকেজে মোট ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার প্রণোদনা অনুমোদন করেছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে এ বছরের একই মাস পর্যন্ত ১৩ মাসে সব প্যাকেজ থেকে বিতরণ হয়েছে ৮২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বা ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। ব্যাংক খাতের মাধ্যমে নেওয়া ১১টি প্যাকেজের আকার ১ লাখ ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে ১০টি প্যাকেজ থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৬৮ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। একটির ঋণ দেওয়া এখনো শুরু হয়নি।

ব্যাংকের মাধ্যমে নেওয়া প্যাকেজগুলোর মধ্যে দুটির আকার ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি মূলধন দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ নেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন দিতে ঘোষণা করা হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটিই সবচেয়ে বড় প্যাকেজ। দুটি মিলিয়ে গত এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা বিতরণ বাকি ছিল।

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ইলেকট্রিক পণ্য খাতের উদ্যোক্তা এম এ বারী শনিবার ক্ষোভের সঙ্গে প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘অনেক বড় প্যাকেজ। তাতে আমার লাভ কী? ২০০৪ সাল থেকে একটি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মিলিয়ে ৩০টি শাখা আছে আমার। করোনায় বিপদে পড়ে গেলে পাঁচ কোটি টাকার দরকার হয়। কিন্তু ব্যাংক দিল না। অথচ ১৫ বছরে ওই ব্যাংক আমার সঙ্গে ব্যবসা করেছে অন্তত ৩৫ কোটি টাকা।’

বাস্তবায়ন শোচনীয়

প্রাক্‌–জাহাজীকরণ ঋণ পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি নামের একটি প্যাকেজে রাখা হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর বাস্তবায়ন শুরু হয় গত বছরের ১৩ এপ্রিল। কিন্তু প্রথম ছয় মাসে এ থেকে পুনঃ অর্থায়ন নিতে আবেদন জমা পড়ে মাত্র একটি। অথচ ৩১টি ব্যাংক পুনঃ অর্থায়ন নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই প্যাকেজ থেকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৪৩ কোটি টাকা। এ প্যাকেজের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো নেবে ৩ শতাংশ সুদে, আর গ্রাহকের কাছ থেকে নেবে ৬ শতাংশ সুদ। বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়নকারী সংস্থা হলেও প্যাকেজটির এমন করুণ দশা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সুবিধায় দুই হাজার কোটি টাকার এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম হাতে নেয় সরকার। গত এপ্রিল পর্যন্ত প্যাকেজটি থেকে কোনো ঋণই দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম প্রাক্‌–জাহাজীকরণ ঋণ পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলেন, এটা রপ্তানির সঙ্গে সম্পর্কিত। রপ্তানি কম হলে স্বাভাবিক কারণেই পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি থেকে বিতরণ কম হয়। তা ছাড়া অন্যান্য ঋণ নেওয়ার কারণে এ কর্মসূচি থেকে রপ্তানিকারকেরা খুব বেশি ঋণ নিতে আগ্রহী হন না। একজন উদ্যোক্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, নিয়মের এমন প্যাঁচ দিয়ে রেখেছে যে এ থেকে ঋণ পাওয়ার আশা কম।

বাস্তবায়ন কিছুটা ভালো

ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতকে সহায়তা দিতে নেওয়া হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার কৃষি পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি। এ তহবিল থেকে কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। সরকার বহন করে বাকি ৫ শতাংশ সুদ। গত এপ্রিল পর্যন্ত তহবিলটি থেকে ৩ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এখনো বাকি আছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য নেওয়া প্যাকেজের আকার তিন হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে এ প্যাকেজের ঋণ দিচ্ছে। আর ব্যাংকগুলো তা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এমআরএ) অনুমোদিত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এফএফআই) দিচ্ছে। এপ্রিল পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা।

রপ্তানিমুখী শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সুবিধা দিতে গঠন করা হয় ১৭ হাজার কোটি টাকার তহবিল। তা থেকে দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এ ছাড়া পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুটির শিল্প, বিদেশফেরত শ্রমিকদের ঋণ দেওয়া। ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

গত ডিসেম্বরের ওই মতবিনিময় সভার সূত্র ধরে শনিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং অত ফরম পূরণের পথে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেতে চান না। তাঁদের প্যাকেজটা এমএফআইয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে ভালো হবে বলে আমি এখনো মনে করি।’