ভবনে ভবনে, ঘরে ঘরে দেশি সিরামিক

বাংলাদেশের সিরামিকশিল্প গত এক দশকে আমূল বদলে গেছে। বিশ্বমানের টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও টেবিলওয়্যার দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। মডেল: বাপ্পা ও মিশু । স্থান: রাজধানীর হাতিরপুলে ডিবিএল সিরামিকের ডিসপ্লে সেন্টার। ছবি: সুমন ইউসুফ
বাংলাদেশের সিরামিকশিল্প গত এক দশকে আমূল বদলে গেছে। বিশ্বমানের টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও টেবিলওয়্যার দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। মডেল: বাপ্পা ও মিশু । স্থান: রাজধানীর হাতিরপুলে ডিবিএল সিরামিকের ডিসপ্লে সেন্টার। ছবি: সুমন ইউসুফ
আমদানি–নির্ভরতা আর নেই। দেশের বাজারের সিংহভাগ চাহিদা মিটিয়ে সিরামিক পণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। ৬,০০০ কোটি টাকার বাজার, ৮,৬১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগের শিল্প নিয়ে এই প্রতিবেদন।


ইতিহাস ছয় দশকের। কুমারের হাতে তৈরি মাটির থালাবাসনের যুগ পেরিয়ে এ ভূখণ্ডে সিরামিকশিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এখন দেশের ঘরে ঘরে, ভবনে ভবনে দেশীয় কারখানার সিরামিক পণ্য। দেশি টাইলসে মানুষ মেঝে সাজাচ্ছে, দেশি স্যানিটারিওয়্যার শৌচাগারের সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে, দেশি তৈজসপত্র আনছে আভিজাত্য। 

রপ্তানিও শুরু হয়েছিল তিন দশক আগে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, ফ্রান্সের প্যারিসে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরের কিছু কিছু পরিবারের থালা, চায়ের কাপ বা কফি মগ হিসেবে বাংলাদেশের তৈজসপত্র ঢুকতে পেরেছিল, এখনো পারছে। অবশ্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নজর ছিল মূলত দেশের বাজারে। দ্রুত বাড়তে থাকা অভ্যন্তরীণ চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে তাঁরা বিদেশে রপ্তানিতে মন দিতে পারেননি। 

বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সিরামিক পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ বাজার স্থানীয় উৎপাদকদের দখলে। কিছু সিরামিক পণ্য আমদানি হয়, যা সব সময়ই হবে বলে মনে করেন উৎপাদকেরা।

দেশে সিরামিক কারখানার সংখ্যা ৬৬টি। এসব কারখানায় যেমন সস্তা দামের পণ্য তৈরি হয়, তেমনি মধ্যম দামের মানসম্মত পণ্যও তৈরি হয়। আবার উচ্চ দামের পণ্য তৈরি করে উচ্চ আয়ের মানুষের বাজারও ধরছেন দেশীয় উৎপাদকেরা। 

যেমন মুন্নু সিরামিকসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি সোনার কারুকার্যে সিরামিক তৈজসপত্র তৈরি করে। তরল সোনা আনা হয় জার্মানি থেকে। মুন্নুর স্বর্ণখচিত তৈজসপত্র রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। আবার একাধিক কারখানা তৈরি করে উন্নত মানের স্যানিটারিওয়্যার ও টাইলস, যা বিদেশি পণ্যকে বাজার থেকে হটিয়ে দিচ্ছে। 

জানতে চাইলে বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সিরামিক খাত একসময় আমদানিনির্ভর ছিল। দেশীয় উদ্যোক্তারা একের পর এক কারখানা করে এখন দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। গত এক দশকে এটা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করছি। এ কারণে দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যাচ্ছে।’ 

তাজমা প্রথম

বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম সিরামিক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। নাম ছিল তাজমা সিরামিক। উদ্যোক্তা ছিলেন একজন পাকিস্তানি নাগরিক। বাংলাপিডিয়া বলছে, তাজমার উৎপাদন খুব সীমিত ছিল। উৎপাদিত পণ্যের মানও তেমন ভালো ছিল না। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে নাম পাল্টে পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ হয়। দেশের স্বাধীনতার পর সিরামিক খাতে ১৯৭৪ সালে ঢাকা সিরামিক ও স্যানিটারিওয়্যার যাত্রা শুরু করে। তারাই দেশে প্রথমবারের মতো স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদন শুরু করে।

অবশ্য সিরামিক খাতের মোড় ঘোরানো বিনিয়োগটি আসে ১৯৮৫ সালে। ওই বছর মুন্নু সিরামিক তৈজসপত্র উৎপাদন শুরু করে। শুরু থেকেই তারা রপ্তানি বাজারে নজর দেয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত উদ্যোক্তা হারুনুর রশিদ খান মুন্নু। তৈজসপত্রের আরেক শীর্ষ কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিকস যাত্রা শুরু করে ১৯৯৯ সালে। 

সিরামিক খাতে বেশির ভাগ বিনিয়োগ এসেছে ২০০০ সালের পর, গত ২০ বছরে। বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ৬৬টি সিরামিক কারখানার মধ্যে ৫৪টিই গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত। এ দেশের সিরামিক খাতের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বেশির ভাগ কারখানা ইউরোপীয় ও জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে গুণগত দিক দিয়ে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করা যায় বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। 

 কোন ক্ষেত্রে কত

সিরামিকের উপখাত তিনটি। তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার। এর মধ্যে এখন সবচেয়ে বড় বাজার টাইলসের। বিসিএমইএর সর্বশেষ হিসাবে টাইলসের বাজারের আকার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ টাইলস দেশেই উৎপাদিত হয়। স্যানিটারিওয়্যারের বাজারের আকার ৯০০ কোটি টাকার বেশি। এ ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ। তৈজসপত্রের বাজারের আকার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ খাতে মোট চাহিদার ৯৩ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হয়। 

সব মিলিয়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বাজারের ৮৫ শতাংশ চাহিদা দেশীয় ৬৬টি কারখানা মেটায় বলে দাবি বিসিএমইএর। কারখানাগুলোর মধ্যে ২৮টি টাইলসের, ২০টি তৈজসপত্রের ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যারের। নতুন আরও ৪ থেকে ৫টি কারখানা আসছে, যারা দু-এক বছরের মধ্যেই উৎপাদনে যাবে। 

 এখন ভালো সময়

সিরামিক খাতে এখন মোটামুটি ভালো সময় কাটছে। এর তিনটি কারণ উল্লেখ করেন বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। প্রথম কারণ, মানুষের আয় বাড়ার কারণে টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও তৈজসপত্র কেনার সক্ষমতা বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ, আবাসন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি আছে, যা সিরামিক পণ্যের চাহিদা বাড়াচ্ছে। তৃতীয় কারণ, আগের মতো গ্যাস–সংকট নেই। ফলে কারখানাগুলো উৎপাদন ক্ষমতার সিংহভাগ ব্যবহার করতে পারছে।

বিসিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সিরামিক পণ্যের বাজারের আকার গত পাঁচ বছরে ২০০ শতাংশ বেড়েছে। সংগঠনটির তথ্যমতে, সামগ্রিকভাবে সিরামিক পণ্যের বাজারে প্রবৃদ্ধি ২০ থেকে ২২ শতাংশ। তবে শুধু টাইলসের ক্ষেত্রে এই প্রবৃদ্ধি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। 

২০১৮ সালের শুরুর দিকে দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয়। সিরাজুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দাম বেড়েছে। কারখানাগুলো উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে। ফলে পুরো খাতের উপকার হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে আরও এলএনজি এলে গ্যাসের পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। 

রসুই কিংবা খাবারের ঘরের প্রয়োজন ও সৌন্দর্যের পুরোটাই দেশীয় সিরামিক প্রতিষ্ঠান পূরণ করছে। ছবি: প্রথম আলো
রসুই কিংবা খাবারের ঘরের প্রয়োজন ও সৌন্দর্যের পুরোটাই দেশীয় সিরামিক প্রতিষ্ঠান পূরণ করছে। ছবি: প্রথম আলো

এখন রপ্তানিতে নজর

সিরামিক খাত এখন রপ্তানির দিকে নজর দিচ্ছে। কারণ, দেশের বাজারের সিংহভাগ দেশিদের দখলে এসেছে। বিনিয়োগ বেড়েছে, যা প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। এখন বাজার বাড়াতে রপ্তানির বিকল্প নেই। 

মুন্নু সিরামিকের মইনুল ইসলাম বলেন, ইউরোপে বাজার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। এত দিন সে নজরটি ততটা ছিল না। এখন অনেকেই রপ্তানিতে নজর দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতেও রপ্তানির সম্ভাবনা বেশ ভালো। কারণ, দেশটিতে ভালো মানের তৈজসপত্র তৈরির কারখানা তেমন একটা নেই। ভারতে একটি বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা মানসম্পন্ন পণ্য কিনতে চায়। আমরা সেই সুযোগ নিতে পারি।’

বিসিএমএ বলছে, বাংলাদেশি সিরামিক পণ্যের মূল রপ্তানি বাজার ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য। রপ্তানি হয় মূলত তৈজসপত্র। আর পাশাপাশি কিছু টাইলস রপ্তানি হচ্ছে। 

অবশ্য সিরামিকের রপ্তানি বাজার ততটা বড় নয়। যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সিরামিক খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৮৭ কোটি টাকা।