ভারতে প্রকাশ্য, বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ

গত এপ্রিল-জুনে ভারতের জিডিপি ২৪ শতাংশ সংকুচিত হয়। ত্রৈমাসিক হিসাব না থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রকৃত ক্ষতি জানা যায়নি।

■ ৪০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হলো।

■ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে।

ভারতের অর্থনীতিতে করোনার ক্ষত ফুটে উঠছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত গোটা ভারত থমকে গিয়েছিল। শুধু ভারত নয়, ওই সময়ে বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিও স্থবির হয়ে গিয়েছিল। এখন ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় বলছে, ওই প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ভারতের অর্থনীতি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। এর মানে, ওই সময়ে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি উল্লিখিত হারে নেতিবাচক হয়েছে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে, ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন মাসে গোটা ভারতীয় অর্থনীতি যদি ১০০ টাকার পণ্য উৎপাদন বা সেবা সৃষ্টি করে। তাহলে এবার তা কমে ৭৬ টাকা হয়ে গেছে। করোনা এমনই সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছে ভারতের অর্থনীতিতে।

এবার বাংলাদেশের দিকে নজর দিই। ভারতের মতো এপ্রিল-জুন মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতিও স্থবির ছিল। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় সব বন্ধ হয়ে যায়। বিপাকে পড়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষ। বন্ধ হয়ে যায় কলকারখানা। অথচ আগস্টে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলেছে, গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িকভাবে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি নির্ধারণ করা হয় না। তাই পুরো অর্থবছরের হিসাব একসঙ্গে দেওয়া হয়। অর্থবছরের প্রথম ৮-৯ মাসের প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে পুরো বছরে সাময়িক হিসাব করা হয়। শেষ তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) হিসাবটি অনুমাননির্ভর। তাই বিবিএসের দেওয়া জিডিপির হিসাবে করোনার প্রভাবও প্রতিফলিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এপ্রিল-জুন মাসে অর্থনীতি প্রায় স্থবির থাকার পরও এত প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো। তাঁরা বলছেন, বিবিএসের হিসাব বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না।

অন্যদিকে ভারত নিজেদের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পরিসংখ্যান নিয়ে সমঝোতা করেনি। যদিও এপ্রিল-জুন মাসের জিডিপির হিসাবের মধ্য দিয়ে বিগত ৪০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হলো। অর্থনীতিবিদ ও ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো আগেই বলেছিল, করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হবে। গতকাল বিকেলে ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় জানিয়েছে, গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মার্চ মাসের শেষ নাগাদ দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেদিনের বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, জীবন বাঁচলে পৃথিবীও বাঁচবে। বড়সড় প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছিলেন। লকডাউনে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো ভারত। ফলে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারতীয় অর্থনীতিতে বড় প্রভাব দেখা যাবে—এটা ধারণার মধ্যেই ছিল।

এক চীন ছাড়া এই প্রান্তিকে বিশ্বের সব বড় অর্থনীতিই সংকোচন হয়েছে। যেমন, আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় গত এপ্রিল-জুন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৫৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। ভারতের অর্থবছর এপ্রিল থেকে মার্চ মাস। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকেই ভারতীয় অর্থনীতিতে ঝিমুনি চলছিল। অটোমোবাইল, উৎপাদন খাত, পরিষেবা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই মন্দার টান। গাড়ি বিক্রি প্রতি মাসেই কমছিল। মারুতির মতো কোম্পানি লোকসানের মুখে পড়ে। ফলে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল গত ১১ বছরের রেকর্ড।

শুধু ভারত নয়, গত এপ্রিল-জুন সময়ে বিশ্বজুড়েই করোনার সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন দেশের হোটেল, রেস্তোরাঁ, পর্যটন, বিমান, পরিষেবা ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে। দেশে দেশে চলে লকডাউন। বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউনবিরোধী। প্রথম থেকেই তিনি বলে আসছেন, এভাবে লকডাউন দেওয়ায় গরিব মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লকডাউনের ধরন ও পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশেও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, কঠোর লকডাউনের পরিবর্তে মানবিক লকডাউন দিলে শ্রমজীবী মানুষের আয় পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

ভারতের লকডাউনের সমালোচনা করেছেন আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও। তাঁর মতে, প্রস্তুতি ছাড়া লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সে জন্য ভারত সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তবু আশার কথা শুনিয়েছেন কৌশিক বসু। তিনি মনে করেন, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে আইটি, আউটসোর্সিং ও স্বাস্থ্যসেবা প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে। আর এই তিন খাতেই ভারত শক্তিশালী অবস্থানে আছে বলে তিনি মনে করেন।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর জিডিপি পরিমাপের পদ্ধতি বদলে দেওয়া হয়। সেই পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। মোদি সরকারের সাবেক প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি পরিমাপের কারণে ২ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অঙ্ক বেশি দেখাচ্ছে।