‘মালিক-শ্রমিক একটি সাইকেলের দুটি চাকা’

পোশাক কারখানার মালিক-শ্রমিকদের উদ্দেশে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, মালিক-শ্রমিক একটি সাইকেলের দুটি চাকা। তাঁদের উভয়ের স্বার্থই দেখতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে আজ শনিবার অনলাইনে অনুষ্ঠিত ‘কোভিড-১৯ সংকট থেকে পোশাক খাতের পুনরুদ্ধার: সরবরাহ ব্যবস্থাভিত্তিক সমাধান কি সম্ভব?’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আর স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রমসচিব কে এম আবদুস সালাম এবং ঢাকায় নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারভেইজ। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক এবং শ্রমিক অধিকারকর্মী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সম্মানিত অতিথি।

ভেবেছিলাম বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মোকাবিলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। পাশাপাশি আমাদের নতুন বাজার খুঁজতে হবে।
টিপু মুনশি,বাণিজ্যমন্ত্রী
সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান শ্রমিকদের জন্য ক্ষুদ্র বিমা চালু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি (যিনি নিজেও একজন পোশাক রপ্তানিকারক) বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মোকাবিলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। পাশাপাশি আমাদের নতুন বাজার খুঁজতে হবে। চীন-ভারতের মতো বড় বাজারগুলোতে ঢুকতে পারলেও বিপদ কমবে।’
বিদেশি ক্রেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, ক্রেতারা যদি পোশাকের ক্রয় আদেশ ঠিক রাখেন আর মূল্য কিছুটা বাড়িয়ে দেন, এ খাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এ খাতের জন্য সরকারের দেওয়া ঋণ সহযোগিতার সময় আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান শ্রমিকদের জন্য ক্ষুদ্র বিমা চালু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চান, ক্রেতা হিসেবে তাঁর কোম্পানি কোনো দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী কি না।

মহামারির এই সময়ে মালিক ও ক্রেতারা হয়তো মুনাফার একটি অংশ হারাবেন, কিন্তু শ্রমিকদের চাকরি না থাকা মানে ঘরে খাবার না থাকা।
কল্পনা আক্তার,নির্বাহী পরিচালক, বিসিডব্লিউএস

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, এই দুঃসময়ে শুধু শ্রমিকেরা নন, মালিকেরাও অসহায়। বিদেশি ক্রেতারা ক্রয় আদেশ বাতিল ও মূল্য কমিয়ে দেওয়ায় কারখানার মালিকদের চুপ করে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। তবে মহামারির এই সময়ে মালিক ও ক্রেতারা হয়তো মুনাফার একটি অংশ হারাবেন, কিন্তু শ্রমিকদের চাকরি না থাকা মানে ঘরে খাবার না থাকা।
কল্পনা আক্তার আরও বলেন, একজন ক্রেতাকে তো আর বলা যায় না, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু করুন। কাজটি সরকারকেই করতে হবে। আর মালিক-শ্রমিক যে সাইকেলের দুই চাকা—এ বিষয়কে শুধু বলার মধ্যে না রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী যেন তা বিশ্বাস করেন, সে ব্যাপারে অনুরোধ করেন কল্পনা আক্তার।
শ্রমসচিব কে এম আবদুস সালাম বলেন, ‘শ্রমিক ছাঁটাই’ দুটি মর্মান্তিক শব্দ। বর্তমান মানবিক সরকার তা চায় না। এ কারণেই কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছে পোশাক খাতকে। এই মুহূর্তে মালিক-শ্রমিকের কোনো দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিও সরকার আশা করে না।

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি কমে যায় ২৩ শতাংশ। জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে শ্রীলঙ্কা থেকে তা কমে যায় ৩১ শতাংশ।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি কমে যায় ২৩ শতাংশ। জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে শ্রীলঙ্কা থেকে তা কমে যায় ৩১ শতাংশ। আসলে কোভিড-১৯-এর কারণে ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য স্তূপ হতে থাকে। কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়। বড় ধরনের মন্দার সময় পণ্যের আমদানি এমনিতেই কমে যায়। এবার মূল্যের ওপরও প্রভাব পড়েছে। ক্রেতারা পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে বিল আটকে রেখেছেন। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা তার পরও ক্রয় আদেশ নিয়েছেন, যেহেতু কোনো বিকল্প ছিল না।

রেহমান সোবহানের প্রশ্নের জবাবে এইচঅ্যান্ডএমের জিয়াউর রহমান বলেন, এইচঅ্যান্ডএম এই সংকট দূর করতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। সংকট মোকাবিলায় সরকার, মালিক, ক্রেতা ও শ্রমিক নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে অবশ্যই এইচঅ্যান্ডএম পোশাকের মূল্য কিছুটা বাড়াতে রাজি আছে।
নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারভেইজ বলেন, কোনো সরকার কোনো কোম্পানিকে সরাসরি নির্দেশনা দিতে পারে না। তবে নেদারল্যান্ডস সরকার সে দেশের পোশাক আমদানিকারকদের বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার আদেশ বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘আমরা এখন দ্বিতীয় সংকটে পড়েছি। এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে।’