মুঠোফোনের টাকা কাটা হয় গ্রাহককে না জানিয়ে

মুঠোফোনে বিভিন্ন সেবা দেয় তৃতীয় পক্ষ।
ছবি: রয়টার্স

আপনি চাননি, চালুও করেননি। তবু মুঠোফোনে চালু হয়ে গেল ওয়েলকাম টিউন। কেটে নেওয়া হলো মুঠোফোন ব্যালেন্সের টাকা।

গ্রাহকদের এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। দুটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ করে বিটিআরসি দেখেছে, তারা গ্রাহকের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন সেবা চালু করে টাকা কেটে নিয়েছে।

দেশের চারটি মুঠোফোন অপারেটরের গ্রাহকদের ওয়েলকাম টিউন ছাড়াও নিউজ অ্যালার্ট, ধর্মবিষয়ক অ্যালার্ট, গান, ভিডিও, মুঠোফোনের গেম ইত্যাদি সেবা দিয়ে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এগুলোকে বলা হয় টেলিকমিউনিকেশন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস। দেশের গ্রাহকেরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন।

এ অভিযোগে দুই মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা ও বাংলালিংকের গ্রাহকদের দেওয়া টেলিকমিউনিকেশন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (টিভ্যাস) বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। এ নির্দেশনা দিয়ে গত মঙ্গলবার কমিশনের পক্ষ থেকে দুই অপারেটরকে চিঠি দেওয়া হয়। বিটিআরসি সূত্র জানায়, এর বাইরে চারটি টিভ্যাস সেবাদাতার সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

১০০ জন গ্রাহককে ফোন করেন বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের কর্মকর্তারা। ৪৬ জন গ্রাহক জানিয়েছেন, টিভ্যাস সেবা চালুর আগে তাঁদের কোনো সম্মতি নেওয়া হয়নি। কেবল ১৭ জন জানান, তাঁদের সম্মতি নিয়ে সেবাটি চালু করা হয়েছে। আর ২৬ জন ফোন ধরেননি এবং ১১ জনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

এর আগে সম্প্রতি বিটিআরসি পার্পেল ডিজিট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও অভি কথাচিত্র লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ছয় মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে। এর মধ্যে পার্পেল ডিজিট কমিউনিকেশনের গ্রাহকসংখ্যা ৭৬ হাজার ৮৬০।

পার্পেল ডিজিট লিমিটেড চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ইকরা নামের একটি সেবার মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা আয় করেছে। এর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১০০ জন গ্রাহককে ফোন করেন বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের কর্মকর্তারা। ৪৬ জন গ্রাহক জানিয়েছেন, টিভ্যাস সেবা চালুর আগে তাঁদের কোনো সম্মতি নেওয়া হয়নি। কেবল ১৭ জন জানান, তাঁদের সম্মতি নিয়ে সেবাটি চালু করা হয়েছে। আর ২৬ জন ফোন ধরেননি এবং ১১ জনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, টিভ্যাস সেবা দেওয়ার নামে টেলিযোগাযোগ খাতে একটা নৈরাজ্য চলছে। যাঁরা ঠিকমতো মুঠোফোনের বার্তা বোঝেন না, পড়তে পারেন না, তাঁদের মূলত টার্গেট করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব নম্বর বন্ধ থাকে, সেসব নম্বরে বিভিন্ন সেবা চালু করে টাকা কেটে নেওয়া হয়। এই নৈরাজ্য বন্ধ করতেই বিটিআরসি তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিটিআরসির ১১ সেপ্টেম্বরের সভায় পার্পল ডিজিট ও অভি কথাচিত্রের সেবা বন্ধের সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি এসব সেবা চালুর ক্ষেত্রে দেশের চারটি মুঠোফোন অপারেটরকে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) চালুর নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি।

মুঠোফোন গ্রাহকের অজান্তেই চালু হয় বিভিন্ন সেবা।
ছবি: রয়টার্স

অভি কথাচিত্র লিমিটেডের গ্রাহকসংখ্যা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭২২। প্রতিষ্ঠানটি ‘ঢালিউড ২৪ নিউজ অ্যালার্ট’ ও ‘ঝালমুড়ি ওয়েব পোর্টাল’ নামক টিভ্যাস সেবা দেয়। তাদের গ্রাহকদের মধ্যে ৯০ জনকে দৈবচয়নে ফোন করে জানা যায়, ৪২ জন গ্রাহকের কাছ থেকেই এই দুই সেবা চালু করার আগে কোনো প্রকার সম্মতি নেওয়া হয়নি। আর ১৭ জন ফোন ধরেননি। ৩১টি মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

বিটিআরসির প্রতিবেদনে এসেছে, অভি কথাচিত্র ঢালিউড ২৪ নিউজ অ্যালার্ট সেবাটির মাধ্যমে চলতি বছরের আগস্ট মাসেই ৪৩ লাখ টাকা আয় করেছে। এর মধ্যে ২৬ লাখ টাকার ভাগ পেয়েছে মুঠোফোন অপারেটরগুলো। জানতে চাইলে অভি কথাচিত্রের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি জাহিদ হাসান অভি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিটিআরসির কাছে ব্যাখ্যা দিয়ে এখন নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিটিআরসির সভার আলোচ্যসূচিতে উত্থাপিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টিভ্যাস সেবার নামে টাকা খোয়ানো ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব বেশি শিক্ষিত নন। মুঠোফোনে খুদেবার্তার মাধ্যমে ফিচার ফোনগুলোকে টার্গেট করে টিভ্যাস সেবা চালু করা হয়ে থাকে। মধ্যরাতের পর এভাবে সেবা চালু করা হয়।

দুই অপারেটরের টিভ্যাস বন্ধ

রবি ও বাংলালিংকের গ্রাহকদের দেওয়া টিভ্যাস সেবা বন্ধের চিঠিতে বিটিআরসি বলেছে, যেসব গ্রাহকের অজান্তে তাঁদের মোবাইলে সেবা চালু হয়ে যায়, তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। অপারেটরের সহযোগিতা ছাড়া এই গ্রাহকগোষ্ঠীর তালিকা টিভ্যাস প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হস্তগত করা সম্ভব নয়। টিভ্যাসের সার্ভিস ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মও অপারেটরের নিয়ন্ত্রণাধীন।

বিটিআরসি অপারেটর দুটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। পাশাপাশি পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত রবি ও বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সব টিভ্যাস বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এ বিষয়ে রবি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে বলা হয়, এ বিষয়ে তারা বিটিআরসির সঙ্গে কাজ করছে। শিগগির বিষয়টি সমাধান হবে বলে তারা আশাবাদী।

বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ব্যাপারে বিটিআরসির সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তাদের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আমাদের মতামত তুলে ধরেছি। বিটিআরসির দেওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য কাজও চালিয়ে যাচ্ছি।’

অ্যামটব কী বলছে

মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) বলছে, ভ্যাস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধন দেয় বিটিআরসি। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি বিটিআরসির কাছে।

অ্যামটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মুঠোফোন অপারেটর সেবাদাতারা দুই স্তরের অথেনটিকেশন (নিশ্চিতকরণ) পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ ছাড়া তাদের প্রতারণা রোধের ব্যবস্থাও আছে। তিনি বলেন, মোবাইল অপারেটর যথাযথভাবে আইন মেনে ব্যবসা করে। এই সেবার ব্যাপারে ভ্যাস প্রোভাইডারদের দায় আছে।

রাতে অ্যাকাউন্টে ৩০ টাকা থাকলে, সকালে উঠে দেখি ১৫ টাকা। প্রতি মাসেই আমার ফোনে এমন কাটে।
আইয়ুব আলী, কৃষক, সাতক্ষীরা

অবশ্য গ্রাহকদের কেউ কেউ অজান্তে টাকা কেটে নেওয়ার অভিযোগ এখনো করছেন। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কৃষক আইয়ুব আলী বলেন, তাঁর মুঠোফোনে প্রায়ই টাকা কেটে নেওয়া হয়। টাকা কাটার আগে মুঠোফোনে খুদেবার্তা দেওয়া হয়। অথচ কেন টাকা কেটে নেওয়া হলো বা এসব খুদেবার্তার মানে তিনি বুঝতে পারেন না। আইয়ুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে অ্যাকাউন্টে ৩০ টাকা থাকলে, সকালে উঠে দেখি ১৫ টাকা। প্রতি মাসেই আমার ফোনে এমন কাটে।’