মৌলভীবাজারের ব্যবসা মন্দা!

রাজধানীর পুরান ঢাকার পাইকারি মোকাম মৌলভীবাজার এলাকায় সারা দিনই প্রচুর ক্রেতাসমাগম ও কেনাবেচার পাশাপাশি যানজটও লেগে থাকে l প্রথম আলো
রাজধানীর পুরান ঢাকার পাইকারি মোকাম মৌলভীবাজার এলাকায় সারা দিনই প্রচুর ক্রেতাসমাগম ও কেনাবেচার পাশাপাশি যানজটও লেগে থাকে l প্রথম আলো

ভোজ্যতেল, চিনি, আটা-ময়দা, ডাল, মসলা—কী নেই পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে। প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্যই এই এক জায়গায় পাওয়া যায়। তাই ঢাকার প্রায় সব খুচরা দোকানিই ছোটেন মৌলভীবাজারে। ঢাকার বাইরের সব জেলার ব্যবসায়ীরাও কমবেশি আসেন।
মৌলভীবাজারকে বলা হয় পুরান ঢাকার ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। কেউ যদি এক ঘণ্টা এই বাজারে ঘোরেন, তাহলে তাঁকে আর বলে দিতে হবে না যে কেন এমনটা বলা হয়। গতকাল শনিবার ছুটির দিনে ঘুরেও দেখা গেল এখানকার ব্যবসায়ীদের কর্মব্যস্ত দিন পার করতে। তবে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বললেন, আগের মতো ব্যবসা হচ্ছে না। তাঁদের ব্যবসায় এখন কিছুটা মন্দা। অবশ্য ভিন্নমতও আছে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন, ঈদুল আজহার পর মাস দু-এক এখানকার ব্যবসা একটু ঢিমেতালেই চলে।
নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে বেগম বাজার হয়ে মৌলভীবাজারে গতকাল সকালে যেতেই রিকশা-ভ্যানের জট। সরু গলির দুই পাশ থেকে আসা রিকশা-ভ্যান ও মাথায় পণ্য নিয়ে ছুটে চলা শ্রমিকের পাশ কাটিয়ে মৌলভীবাজারের প্রধান সড়কে পৌঁছাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। তবে চিরচেনা এই দৃশ্যপটে স্থানীয় সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত। এই যানজটই এই বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মজার বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ধরেই নিয়েছেন এটি চিরস্থায়ী সমস্যা, মুক্তি মিলবে না কখনোই।
বিভিন্ন ধরনের মশার কয়েল পাওয়া যায় মেসার্স হাজি আ. রহমান নামের দোকানে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যানজট ছাড়া এখানে আর কোনো সমস্যা নেই। পুরো এলাকা ঘিঞ্জি আর সড়ক সরু—এটা মেনে নিয়েই আমরা ব্যবসা করছি। তবে রোজার ঈদের সময় সড়কের যান চলাচল ঘরমুখী করা হয়। তখন একটু অবস্থার উন্নতি হয়।’
ব্যবসা কেমন চলছে প্রশ্ন করলে হাবিবুর রহমান বললেন, ‘শীত চলে আসছে, তাই কয়েলের চাহিদা এখন কম। ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখন আসছেন। তবে বছরের শুরুতে হরতাল-অবরোধের পর ভালো ব্যবসা হয়েছে।’ ব্যবসা বর্তমানে কেমন জানতে চাইলে বলেন, আগে কোনো ক্রেতা ২০ হাজার কয়েল কিনলে এখন কিনছেন ৫ হাজার।’
হাবিবুরের দোকানের উল্টো পাশেই মেসার্স বি এম ট্রেডিং। দোকানটিতে বিক্রি হয় জিরা, এলাচ, দারুচিনি, আলু বোখারা, কিশমিশ, সাগু ও সোডা। দোকানের স্বত্বাধিকারী ফিরোজ আলম বললেন, ‘ব্যবসার অবস্থা কী বলব। খুব খারাপ। উৎসব এলে বেচাবিক্রি বাড়ে। কোরবানির ঈদের পর এক-দুই মাস বেচাবিক্রি কম হয়।’ তবে বিয়েশাদির মৌসুম আসছে, তখন বেচাবিক্রি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মাস তিনেকের ক্ষতি কি পোষানো গেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে হাবিবুর রহমান ও ফিরোজ আলম দুজনই বলেছেন, কোনো এক সময়ের ক্ষতি অন্য সময়ে পোষানো যায় না। তবে পণ্য পরিবহন চালু থাকলে সব সময়ই কিছু না কিছু ব্যবসা হয় এখানকার ব্যবসায়ীদের।
দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল প্রায় প্রতি দোকানেই দু-চারজন ক্রেতা বসে আছেন, পণ্য দেখছেন। আবার মাথায় করে পণ্য ভ্যানগাড়িতে ওঠাতে ব্যস্ত দেখা গেল অনেক শ্রমিককে। সব মিলিয়ে বেশ সরগরম।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি জানায়, এখানে শতাধিক আমদানিকারক আছেন, যাঁরা ঋণপত্র খুলে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য কিনে আনেন। তাঁদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে ব্যবসা করেন। সমিতির সদস্যসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার হলেও পুরো মৌলভীবাজারে ৮-১০ হাজার দোকান আছে। প্রতি দোকানে পাঁচ থেকে ১৫ জন করে শ্রমিক কাজ করেন। সঠিক হিসাব না থাকলেও দৈনিক কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই মৌলভীবাজারের ভোগ্যপণ্যের কেনাবেচায়।
সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মৌলভীবাজারে আগের মতো রমরমা ব্যবসা আর নেই। সব ধরনের পণ্যের দামই কমে গেছে। তারপরও ক্রেতা কম। আসলে এখানে আমদানিকারকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানি করে অনেকেই পোষাতে পারেন না।
বছরের এই সময়টায় ব্যবসা একটু কি কম হয়—জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি বলেন, চাল, ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের তো কোনো মৌসুম নেই। সারা বছরই কমবেশি চাহিদা থাকে। তবে আগের মতো ব্যবসা আর হচ্ছে না। তবে সামনে হতে পারে, এমনটাই প্রত্যাশা তাঁর। যানজট সমস্যার নিয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম যানজট সমস্যা নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন। দেখা যাক কী হয়।’