যশোরে পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা দরকার

ফুল, সবজি ও মাছ উৎপাদন এবং হালকা প্রকৌশল ও সুচিশিল্পের জন্য যশোরের সুখ্যাতি রয়েছে। এখানে স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর আছে এবং আকাশ, রেল, নৌ ও সড়কপথের যোগাযোগও ভালো। ঢাকা, উত্তরবঙ্গসহ ১৮টি জেলার যানবাহন চলাচল করে যশোরের ওপর দিয়ে। অর্থাৎ ভৌগোলিকভাবে যশোর বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তারপরও এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের তেমন উন্নতি হয়নি, ভারী শিল্পও গড়ে ওঠেনি। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গ কথা বলেছেন যশোর বিসিকের এম ইউ সী ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিনবারের সিআইপি শ্যামল দাস। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনিরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যশোরের ব্যবসা-বাণিজ্য কি করোনাকালের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছে?

শ্যামল দাস: ব্যবসা–বাণিজ্য এখনো আগের অবস্থায় ফেরেনি। সরকারি প্রণোদনা ঋণপ্রাপ্তি ও কিস্তি পরিশোধে ছাড়সহ যেসব সুবিধা আমরা এখন ভোগ করছি, সেগুলো উঠে গেলে বোঝা যাবে যে আমাদের আর্থিক অবস্থা কতটা ভালো আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যশোরে তিন ধরনের বন্দর ও চার ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে না কেন?

শ্যামল দাস: সারা দেশের সঙ্গে যশোরের যোগাযোগব্যবস্থা খুবই ভালো। তারপরও এখানে ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে না। এর মূল কারণ হলো বিনিয়োগের আকর্ষণের বিষয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক শিল্প উদ্যেক্তাদের কাছে যশোরে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। যে প্রতিষ্ঠানটির এ দায়িত্ব পালন করার কথা, সেই যশোর চেম্বার অব কমার্স কয়েক বছর ধরে অকার্যকর রয়েছে। ফলে সরকার বা বড় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেনদরবার করা হচ্ছে না। এ ছাড়া চেম্বার সক্রিয় থাকলে সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নিতে পারত। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি, হচ্ছেও না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যশোর চেম্বার অব কমার্স অকার্যকর কেন?

শ্যামল দাস: রাজনৈতিক কারণে চেম্বারের নির্বাচন হচ্ছে না। জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি এখন চেম্বারের দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যশোরে উৎপাদিত ফুল, সবজি ও মাছ সারা দেশে সরবরাহ হলেও এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসছে না কেন?

শ্যামল দাস: যশোরে পাইপলাইনে গ্যাসের সংযোগ না থাকায় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তবে এখানকার উৎপাদিত সবজি, ফুল ও মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু প্রা‌ন্তিক পর্যায়ের মানুষ, অর্থাৎ কৃষকেরা সেভাবে অর্থনৈতিক সুফল পাচ্ছেন না। তাই যশোরে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণে পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তাহলে কৃষকেরা সরাসরি পণ্য বিক্রি করে লাভবান হবেন। এ ছাড়া যশোর জেলায় ঐতিহ্যবাহী সুচিশিল্পের সঙ্গে বিপুলসংখ্যায় নারী উদ্যোক্তা জড়িত থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতা ও পণ্য বিপণন সুবিধার অভাবে তাঁরা টিকে থাকতে পারছেন না। সে জন্য উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন ও বিপণনের জন্য সরকারিভাবে জেলায় একটি সমন্বিত মার্কেট স্থাপন করা হলে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারতেন। সেই সঙ্গে প্রা‌ন্তিক পর্যায়ের মানুষজনও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার সুযোগ পেতেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হিমায়িত চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থা এখন কেমন?

শ্যামল দাস: হিমায়িত চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র এক থেকে দেড় শতাংশ। বিদেশে বাংলাদেশের উৎপাদিত গলদা ও বাগদা চিংড়ির ভালো চাহিদা থাকলেও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা দিন দিন চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তবে করোনার প্রভাবে বিদেশে হিমায়িত চিংড়ির দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এতে কৃষকেরা কিছুটা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু এটি টেকসই কোনো সমাধান নয়। টেকসই সমাধান হিসেবে আমাদের ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষে যেতেই হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হলে আন্তর্জাতিক চিংড়ি বাজারের ৫ থেকে ৬ শতাংশ হিস্যা বাংলাদেশের দখলে চলে আসতে পারে। কিন্তু সরকার এখনো পরীক্ষামূলক চাষের মধ্যেই রেখেছে ভেনামি চিংড়ি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যশোরে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আর কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

শ্যামল দাস: দেশের প্রথম হাইটেক পার্ক যশোরে স্থাপিত হলেও তা কার্যত অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। সফটওয়্যার তৈরির যে লক্ষ্য নিয়ে এই পার্ক স্থাপন করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হয়নি। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কলসেন্টার আর প্রশিক্ষণের আয় দিয়ে উদ্যোক্তারা টিকে আছেন। অথচ সরকার এসব উদ্যোক্তাকে কাজ দিয়ে হাজারো তরুণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারত। এ ছাড়া যশোরের হালকা প্রকৌশলশিল্পে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ খাতের আরও বিকাশ ঘটানোর সুযোগ রয়েছে। তাই এখানে হালকা প্রকৌশল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যেতে পারে। তাহলে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্থানীয়ভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সহজ হবে।