রিটার্ন জমা না দেওয়ার পাঁচ কারণ

এক পৃষ্ঠার ফরম পূরণ করেই এবার আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া যাবে।
প্রতীকী ছবি

জীবনধারণের জন্য আপনি আয় করবেন। সেই আয়ের একটা অংশ সরকারি কোষাগারে কর হিসেবে জমা দেবেন—এটাই নিয়ম, এটাই আইন। কিন্তু বাংলাদেশে দেড় শতাংশের মতো মানুষ প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের হিসাব জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগে বার্ষিক রিটার্ন জমা দেন। কর প্রাপ্য হলে তাঁরা করও দেন। ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২৫ লাখের মতো এমন করদাতা আছেন। করযোগ্য আয় থাকলেও বাকিরা কর দেন না।

কেন করদাতারা কর দিতে আগ্রহ দেখান না, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে রিটার্ন জমা না দেওয়ার মোটাদাগে পাঁচটি কারণ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো­ সচেতনতা কম, হয়রানির ভয়, কর বিভাগের সক্ষমতার ঘাটতি, জটিল হিসাব পদ্ধতি ও উচ্চ করহার।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হয়রানির ভয়ে কর অফিসে যেতে চান না করদাতারা। আবার কর দেওয়ার প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। কর দেওয়ার ব্যবস্থা সহজ করলে এমনিতেই করদাতারা কর দিতে উৎসাহিত হবেন। এ জন্য কর বিভাগে ব্যাপকভাবে অটোমেশন প্রয়োজন। নতুন আয়কর আইনে এসব বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত।

কর দিয়ে কী হবে

এ দেশে উন্নয়নমূলকসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। এর বড় অংশ জনগণকেই দিতে হয়। বিদেশি সহায়তা এখন আর খুব বেশি আসে না। আবার রাষ্ট্রমালিকানাধীন খুব বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও নেই, যারা অর্থের জোগান দেবে। তাই কর কিংবা ঋণের জন্য জনগণের ওপরই ভরসা করতে হয়। অথচ এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। আবার করযোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনার জোরালো উদ্যোগেরও ঘাটতি রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার বহু উন্নত দেশ তাদের রাজস্ব আয়ের অর্ধেকের বেশি প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে পায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানেও জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মানুষ কর দেন।

এসব দেশের রাজস্ব বিভাগের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ভুটানের জনসংখ্যা ৭ লাখ ৫৪ হাজার। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার করদাতা রিটার্ন দিয়েছেন সে দেশে। অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ করের আওতায় আছেন। নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ। ওই দেশে ৩০ লাখ করদাতা কর দেন। অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ করের আওতায় আছেন। শ্রীলঙ্কার অবস্থাও তুলনামূলক ভালো। ২ কোটি ১৬ লাখ জনসংখ্যার এ দ্বীপ দেশে মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ কর দেন। দেশটির করদাতার সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬৩ লাখ নাগরিকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। এ বছর নির্ধারিত সময় শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২৩ লাখ। টিআইএনধারীর মাত্র ৩৭ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছেন। অবশ্য আরও তিন লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দেওয়ার জন্য দুই মাস সময় বাড়িয়েছেন।

হয়রানির ভয়

সাধারণ করদাতাদের মধ্যে কর নিয়ে একধরনের ভীতি আছে। তাঁদের শঙ্কা—একবার করজালে ঢুকে গেলে প্রতিবছরই কর দিতে হবে। আবার কর কার্যালয়ের হয়রানির ভয় তো আছেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো একবার টিআইএন নিলে প্রতিবছর কর দিতে হবে, এটা ঠিক নয়। করযোগ্য আয় থাকলেই শুধু কর দিতে হবে। তা না হলে ‘শূন্য’ রিটার্ন দিলেই হয়। তবে হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। করদাতাদের কর কার্যালয়ে গিয়ে রিটার্ন জমাসহ করসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে করদাতাদের নানাভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে কর কার্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে। এ ধরনের হয়রানি রোধে তাই এ বছর থেকে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা আবার চালু করা হয়েছে।

জটিল হিসাব পদ্ধতি

করের হিসাব-নিকাশও বেশ জটিল। একজন সাধারণ নাগরিক বা স্বল্পশিক্ষিত করদাতার পক্ষে এ হিসাব-নিকাশ করা কঠিন। মোটাদাগে বার্ষিক আয়ের ওপর কর বসে না। করমুক্ত আয়সীমার আয় বাদ দেওয়া; তারপর স্তরভিত্তিক আয়ের ওপর আলাদা করে করহার অনুযায়ী করের হিসাব করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং গণিতে পাকা হতে হবে। এ ছাড়া বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা ভাতার করমুক্ত সীমা জেনে হিসাব করতে হয়। আবার সঞ্চয়পত্র, এফডিআর কিংবা শেয়ারবাজারসহ সরকার অনুমোদিত নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ করে কর রেয়াত নেওয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। পাশাপাশি তা হিসাব করার জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় করদাতাদের। হিসাব-নিকাশের এসব ঝামেলা এড়াতে অনেকে করজালে আসতে চান না কিংবা রিটার্ন দিতে চান না।

ভারতে একটি নিয়ম চালু আছে। যেমন কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বার্ষিক বেচাকেনা ৫০ রুপির কম হলে তাঁকে কোনো হিসাব-নিকাশের ঝামেলায় না গিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই তা মেনে নেয় সে দেশের কর বিভাগ। বাংলাদেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হলে ভালো সাড়া মিলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

করহার বেশি

বাংলাদেশে করহার তুলনামূলক বেশি। এ করহার ৫ থেকে ২৫ শতাংশ। যাঁদের তিন কোটি টাকার ওপরে সম্পদ আছে, তাঁদের করের ওপর সারচার্জ দিতে হয়। করহার বেশি হলেও কর রেয়াতের সুযোগ কম। এমনকি উৎসে কর কেটে রাখার পর তা যদি ফেরতযোগ্য হয়, তা–ও ফেরত পাওয়া যায় না। অনেক খাতের উৎসে কর চূড়ান্ত দায় হিসেবে বিবেচিত করা হয়। যেমন গাড়িমালিকদের প্রতিবছর কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা উৎসে কর দিতে হয়। কিন্তু ওই গাড়ির মালিকের যদি করযোগ্য আয় বা উৎসে কেটে রাখা কর ফেরতযোগ্য হয়, তবে সেই টাকা আর তিনি পাবেন না।

বাংলাদেশের একশ্রেণির সামর্থ্যবানেরা উচ্চ করহারের কারণে করজালে আসতে বা রিটার্ন দিতে উৎসাহিত হন না। আয় বা সম্পদ লুকিয়ে রাখেন তাঁরা।

এক কর্মীর হাতে এক হাজার কর নথি

গত এক দশকে আয়কর আদায়ের লক্ষ্য কয়েক গুণ বাড়লেও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এনবিআরের জনবল বাড়েনি। বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়, এমন কিছু উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস খোলা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব আছে। ৬৩ লাখ টিআইএনধারীর জন্য আয়কর বিভাগে সর্বসাকল্যে লোক আছেন ৬ হাজার ২৬২ জন। আয়কর বিভাগের একজন কর্মীর কাছে গড়ে এক হাজার ছয়টি কর নথি পড়ে। এর বাইরে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে করদাতাদের কর নথিও তাঁদের দেখাশোনা করতে হয়। ফলে এত চাপ নিয়ে নিজস্ব সৃজনশীলতা ও কৌশল খাটিয়ে কর আহরণ বৃদ্ধি বা করদাতাদের সচেতন করার উদ্যোগ তাঁদের মধ্যেও দেখা যায় না।

আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর হলো রাজস্ব আহরণের ভিত্তি। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে বেশি মানুষ আয় করবেন, বেশি মানুষ করের আওতায় আসবেন। অর্থনীতির সুফল তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছালে শহর-গ্রামনির্বিশেষে মানুষের আয় বাড়বে। করদাতার সংখ্যা বাড়বে। কর-জিডিপি অনুপাতও বাড়বে। গত এক দশক দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত। করোনার আগে পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। এক দশকে মাত্র দশ লাখের মতো নতুন করদাতা যুক্ত হয়েছে।