রিটার্ন দাখিলের সময় কি বাড়ছে

করোনার কারণে এবার আশানুরূপ আয়কর রিটার্ন জমা পড়ছে না। অনেকের আয়ও কমেছে।

আয়েশা বেগম উত্তরার বাসিন্দা। বয়স ৭৫ বছর। ঢাকায় তাঁর নামে একটি বাড়ি থাকার কারণে এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দিতে হয়। ছেলেমেয়েরা কাছে না থাকায় প্রতিবছর তাঁর স্বামী রিটার্ন জমার যাবতীয় কাজ করে থাকেন। করোনা এবার আয়েশা বেগমের জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে এল। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাঁর স্বামী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এখনো সুস্থ হননি। তাই এখনো রিটার্ন জমার জন্য কাগজপত্র জোগাড় করাসহ কোনো কাজই হয়নি।

আয়েশা বেগমের মতো অনেক করদাতা এমন বিপাকে পড়েছেন। অনেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাইবোন, মা-বাবাসহ নিকটজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে রিটার্ন জমায় আগের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যাংক হিসাবের তথ্যসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করার কাজকর্ম করতে পারেননি। আবার অনেকের আয় কমে যাওয়ায় বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমায় তেমন আগ্রহ নেই। তাঁদের কাছে জীবিকা আগে।

এদিকে করোনার কারণে এবার কর মেলা হচ্ছে না। প্রতিটি কর অঞ্চল কার্যালয়ে কর মেলার সুবিধা থাকলেও সেখানে এবার ভিড়ভাট্টা তেমন একটা নেই। এ অবস্থায় ৩০ নভেম্বর রিটার্ন জমার সময় শেষ হচ্ছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোর সরাসরি কোনো সুযোগ নেই। ফলে করোনার মতো মহামারিতে সময় বাড়ানো কিংবা অন্য কোনো উপায়ে কীভাবে করদাতাদের স্বস্তি দেওয়া যায়, সেই পথ খুঁজছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যদিকে অনিশ্চয়তায় আছেন বহু করদাতা।

এবার দেখা যাক পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কী করেছে। ভারতেও ৩০ নভেম্বর রিটার্ন দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা ছিল। ভারতের করদাতারা এপ্রিল থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব দেন। কিন্তু এবার করোনা মহামারির কারণে গত অক্টোবর মাসে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়ে দিয়েছে, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দেশের করদাতারা রিটার্ন দিতে পারবেন। এর মানে, করোনার কারণে ভারতের করদাতারা এক মাস বাড়তি সময় পেলেন। কিন্তু বাংলাদেশে রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোয় আইনি বাধা আছে। কয়েক বছর আগেও প্রতিবার রিটার্ন জমার সময় বাড়ানো হতো। কিন্তু ২০১৬ সালে আয়কর অধ্যাদেশে পরিবর্তন এনে ৩০ নভেম্বর জাতীয় কর দিবসের পর রিটার্ন জমা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সময় বাড়ানোর পথটি বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে এই করোনা সংকটে কী উপায় আছে?

ভিন্ন একটি উপায় আছে। গত বাজেটের আগে করোনা মহামারি বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। সেই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এনবিআর চাইলে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের যেকোনো জরিমানা ও সুদ মওকুফ করে দিতে পারবে। বাজেট অধিবেশনে এনবিআরের এই ক্ষমতাকে আয়কর অধ্যাদেশের ১৮৪(জি) ধারা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। তাই এনবিআর এখন চাইলে সময় না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জরিমানা ও সুদ মওকুফ করলেই সময় বৃদ্ধির কাজটি হয়ে যাবে। এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, করোনা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এমন বিকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন কত পড়েছে, তা দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ দিয়ে সরাসরি সময় বাড়ানো হতে পারে। কিংবা প্রজ্ঞাপন দিয়ে এক-দুই মাসের জন্য জরিমানা ও সুদ মওকুফ করা হতে পারে। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী, আয়কর আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীরা রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এনবিআরে চিঠি দিয়েছেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার রিটার্ন জমার সময় বাড়ানো উচিত। এক মাসের জন্য জরিমানা ও করের টাকার ওপর সুদ মওকুফ করলেও করদাতারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের রিটার্ন জমা থেকে খুব বেশি আয়কর পাওয়া যায় না। এ ছাড়া রিটার্ন জমার সময় বাড়ালেও এক-দুই মাস পর সেই কর এনবিআর পাবে। তাই সময় বাড়ালে কিংবা জরিমানা ও সুদ মওকুফ করলে এনবিআরের তেমন একটা ক্ষতি হবে না। কারণ, বেশির ভাগ আয়কর আসে উৎসে কেটে রাখা কর থেকে।

বর্তমানে দেশে ৪৬ লাখ কর শনাক্তকারী নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ২০-২২ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দেন। এবার থেকে তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব টিআইএনধারীর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করেছে এনবিআর। কোনো অনিবাসীর দেশে স্থায়ী ভিত্তি না থাকলে এবং জমি বিক্রি ও ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য টিআইএন নিলে তাঁদের রিটার্ন দাখিল করতে হয় না। বাকিদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দিতে না পারলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে দুই থেকে চার মাস পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নেওয়া যায়। এ জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। তখন একজন কর কর্মকর্তা আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী জরিমানা, করের ওপর ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সরল সুদ কিংবা করের টাকার ওপর মাসিক ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ আরোপ করতে পারবেন। আবেদন করে সময় পেলেও বিলম্ব সুদ দিতে হবে, জরিমানা দিতে হবে না।