লুটের টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা

পি কে হালদার
ছবি: সংগৃহীত

মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক অলোক কুমার দাশ এসটিএল নামের ওয়্যারহাউস বিক্রি করেছেন। নথিপত্রে ক্রেতা সোহেল মুরাদ, কিন্তু টাকা এসেছে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী আরেকজনের পক্ষেই পি কে হালদার এই অর্থ দিয়েছেন।

এ হচ্ছে পি কে হালদারের নানা কীর্তির একটি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর অস্তিত্বহীন ও নামমাত্র গড়ে ওঠা চারটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার কিনে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর কাগুজে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বের করা হয়। মালিকানা দখল ও টাকা লুণ্ঠনে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন এই পি কে হালদার। এই অর্থের বড় অংশই নিজে আত্মসাৎ করেছেন, কিছু অংশ ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন। তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। এখন পি কে হালদার পলাতক, আর আইএলএফএসএলের আমানতকারীরা টাকা ফেরত পেতে দরজায় দরজায় ঘুরছেন।

দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পি কে হালদারের দুর্নীতি নিয়ে এখন বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁকে তলব করেই যাচ্ছে। অথচ একসময় সবার চোখের সামনেই সব ধরনের অনিয়ম করেছেন তিনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা এ কাজে তাঁকে সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে গেছেন। তাঁর দখল করা পিপলস লিজিং দেউলিয়া পর্যায়ে যাওয়ার পরেই সবার টনক নড়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পি কে হালদার যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা বের করেছিলেন, তার মধ্যে ২৮ কোটি টাকা পেয়েছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এ কে এম সাহিদ রেজা। আর মেঘনা ব্যাংকের দুই পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন ও অলোক কুমার দাশ এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পেয়েছেন ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বিএফআইইউ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে সুবিধাভোগী ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

আদালতের আদেশে আইএলএফএসএলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া যায়, এ জন্যই দায়িত্ব নিয়েছি। সব পক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। অনেকে বলছে, পি কে হালদার ছাড়া টাকা ফেরত আসবে না। কী করা যায়, শিগগির পরিচালনা পর্ষদ বসে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

এর আগে আদালত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই পদত্যাগ করেন। পি কে হালদারের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানো সম্ভব না বলে জানিয়েছিলেন।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে লুট করেছেন ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।

ওয়্যারহাউস কেনার টাকার জোগান

শাখাওয়াত হোসেন ও অলোক কুমার দাশ দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক বন্ধু। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছেন প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, স্পিনিং, ইনস্যুরেন্সসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের মেঘনা ব্যাংকের পরিচালকও হয়েছেন। পি কে হালদারের লুটের ৩৪ কোটি টাকার সুবিধাভোগীও এই দুই ব্যবসায়িক বন্ধু ও তাঁদের পরিবার।

পি কে হালদার দখল করার পর এমটিবি মেরিন লিমিটেডের নামে ৬০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। কাগুজে এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পূর্ণিমা রানী হালদার, তিনি আইএলএফএসএলের পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রীর স্ত্রী।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ঋণের ১৪ কোটি টাকা জমা হয় অলোক কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রী অনিতা দাশের প্যারামাউন্ট অ্যাগ্রো এবং তাঁদের পুত্র রঙ্গন দাশের হিসাবে। ওই টাকা দিয়ে মেঘনা ব্যাংকের স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখা হয় শাখাওয়াত হোসেনের পুত্র সাদাব হোসেনের নামে।

আবার কোলোসিন লিমিটেডের ৮০ কোটি টাকা ঋণের ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা জমা হয় প্যারামাউন্ট স্পিনিংয়ের হিসাবে। এর পরিচালক অলোক কুমার দাশ, অনিতা দাশ ও শাখাওয়াত হোসেন। মুন এন্টারপ্রাইজের ৮৩ কোটি টাকা ঋণের ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা হয় প্যারামাউন্ট স্পিনিং এবং তাঁদের পুত্র রঞ্জন দাশের মার্কেন্টাইল, মেঘনা ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের হিসাবে। আর কনিকা এন্টারপ্রাইজের ঋণের ১ কোটি টাকা জমা হয় সাদাব হোসেনের হিসাবে।

অলোক কুমার দাশের কাছে জানতে চেয়েছিলাম পি কে হালদারের সঙ্গে আপনার সঙ্গে সম্পর্ক কী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পি কে হালদারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়েছে বলে শুনেছি।’

তাহলে আপনার হিসাবে পি কে হালদারের কাগুজে প্রতিষ্ঠান টাকা দিল কেন, জানতে চাইলে অলোক কুমার দাশ বলেন, ‘সোহেল মুরাদের কাছে এসটিএল ওয়্যারহাউস বিক্রি করেছি। তাঁর টাকা এসব হিসাব থেকেই এসেছিল। এর বেশি কিছু মনে করতে পারছি না।’

বিক্রি করলেন সোহেল মুরাদের কাছে, টাকা এল পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠান থেকে। এটা কীভাবে হয়? এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর তাঁকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

তাহলে এসটিএল ওয়্যারহাউসের আসল মালিক কে? এ প্রশ্ন উঠছে সংশ্লিষ্ট মহলে। সোহেল মুরাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

সুবিধাভোগী সাহিদ রেজাও

এমটিবি মেরিন লিমিটেডের ৬০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয় ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই ঋণ হিসাব থেকে এ কে এম সাহিদ রেজার মালিকানাধীন পদ্মা ওয়েভিং, পদ্মা ব্লিচিং, ফ্যাশন প্লাসের মার্কেন্টাইল ব্যাংকে থাকা হিসাবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা জমা হয়।

উইন্টেল ইন্টারন্যাশনালের ৬৮ কোটি টাকা ঋণের ১৪ কোটি টাকাও যায় সাহিদ রেজার ৪ প্রতিষ্ঠানে। গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্টের ৬৪ কোটি টাকা ঋণের ৭ কোটি টাকা জমা হয় পদ্মা ওয়েভিং ও ফ্যাশন প্লাসের হিসাবে। এভাবে পি কে হালদারের কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ঋণের ২৮ কোটি টাকা জমা হয় সাহিদ রেজার বিভিন্ন হিসাবে।

জানতে চাইলে এ কে এম সাহিদ রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিলায়েন্সের এমডি হিসেবে তাকে চিনতাম। এর বাইরে পি কে হালদারের সঙ্গে আমরা কোনো ব্যবসা ছিল না। আমি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নিয়েছিলাম, যা শোধ দিয়ে যাচ্ছি। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

তাহলে ঋণ হিসাবের টাকা আপনার প্রতিষ্ঠানে কেন? এ নিয়ে এ কে এম সাহিদ রেজা বলেন, ‘আমার হিসাবে শুধু প্রতিষ্ঠানটির ঋণের টাকা জমা হয়েছে। অন্য কোনো চেক জমা হয়নি। এর সব প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।’

এ তো গেল পি কে হালদারের ঋণের সুবিধাভোগীর হিসাব। পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি থেকে নিজের নামেও ঋণ নিয়েছেন সাহিদ রেজা, যা এখন শোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে পদ্মা ওয়েভিংয়ের ঋণ ৬৫ কোটি টাকা ও এমওএইচ ফ্যাশনের ৫৫ কোটি টাকা।

এ নিয়ে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আইএলএফএসএল ২০১৯ সাল থেকে গ্রাহকদের টাকা দিতে না পারলেও ওই বছরের ৮ জুলাই নতুন করে প্রায় ২৩ কোটি টাকা ঋণসীমা বাড়ানো হয়।’ ফলে আইএলএফএসএলের নিয়ন্ত্রণ পি কে হালদারের হাতে যাওয়ার পর কতভাবে সুবিধা পেয়েছেন সাহিদ রেজা, তা বিএফআইইউর প্রতিবেদনেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।

প্রতিষ্ঠানটিতে যে পরিমাণ ঋণ লুণ্ঠন হয়েছে, তাতে তিন ব্যাংক পরিচালক সামান্যই সুবিধা পেয়েছেন। মূল সুবিধাভোগী আসলে পি কে হালদারই। দেশে নিজের নামে ও বেনামে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ভারত ও কানাডায় অর্থ পাচার করেছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। নিজেও একসময় পালিয়ে গেছেন।

পি কে হালদারের যত দুর্নীতি

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আইএলএফএসএলের লুটের মধ্যে ৪৪৬ কোটি টাকা জমা হয় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে, ২২২ কোটি টাকা যায় পি কে হালাদার ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক এশিয়ার ধানমন্ডি শাখার হিসাবে, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় যায় ১২০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় ১৮৪ কোটি টাকা এবং ওয়ান ব্যাংকের স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে যায় ৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া এ কে এম সাহিদ রেজার প্রতিষ্ঠানে গেছে ১০৪ কোটি টাকা।

জানা গেছে, মালিকানা ও ঋণের বেশির ভাগ শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।

পি কে হালদার যে দুটি প্রতিষ্ঠানের এমডি ছিলেন, দুটিই ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। আবার গত ১৮ জুলাই আইএলএফএসএলের এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন একই গ্রুপের মালিকানাধীন কমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি আবদুল খালেক খান।

আবদুল খালেক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন চেয়ারম্যান আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। বড় ঋণগুলো চেয়ারম্যান সাহেব দেখছেন। যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের সম্পদ খোঁজা হচ্ছে। কীভাবে টাকা উদ্ধার করা যায়, তার চেষ্টা চলছে।’

পি কে হালদারের দখল করা অন্য তিন প্রতিষ্ঠান হলো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এই তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন,‘আমি দায়িত্ব নিয়ে দেখেছিলাম পি কে হালদার পুরো টাকা বের করেছে, আর সুবিধাভোগীও অনেকে। যারা জড়িত ও সুবিধাভোগী, তাদের সবার সম্পত্তি জব্দ করার উচিত। যাতে কেউ সম্পত্তি হস্তান্তর করতে না পারে। পুরো প্রতিষ্ঠানটি তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এটাকে হালকাভাবে দেখলে চলবে না। এতে অন্যরা উৎসাহিত হবে।’