ব্যাংক সংস্কার কমিটির জন্য লোক খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক

৯ সদস্যের কমিটিতে বর্তমান ও সাবেক ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ থাকবেন। সরকারের সম্মতির পর কমিটি গঠনের জন্য সদস্য খোঁজা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক

অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের নির্দেশনা মেনে ব্যাংক খাতে ঋণ অনুমোদন, বিতরণ ও আদায়ের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেওয়ার পরই কমিটি গঠনের জন্য সদস্য খোঁজার কাজ শুরু হয়েছে। কমিটির সুপারিশ মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো এক সাবেক ডেপুটি গভর্নরকে করা হবে এই সংস্কার কমিটির প্রধান। এতে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন ব্যাংকারকে রাখা হবে, যাঁরা দক্ষ ও তুলনামূলক সৎ বলে পরিচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে একজন ডেপুটি গভর্নরকেও কমিটির সদস্য করা হবে।

কমিটির সদস্য খোঁজার প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকারকেও চিঠি দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা মেনে ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার থেকেও অনুমতি মিলেছে। ফলে দ্রুত সময়ে এ নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে।

ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ব্যাংকঋণের ওপর সুদ মওকুফসংক্রান্ত বিষয় তদন্ত এবং তা বন্ধে সুপারিশ প্রণয়নে কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই নির্দেশনা দেন। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে রিটটি করে। সংগঠনটি তখন ব্যাংক খাতের ২০ বছরের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের তথ্য তুলে ধরে। সেই রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৯ সালের নভেম্বরে কমিটি গঠনের ওই রায় দেন।

ব্যাংক খাতে এত লুটপাট হচ্ছে, কারও শাস্তি হচ্ছে না। এরপরও কমিটি গঠনের উদ্যোগে স্বস্তি পেলাম। কমিটি গঠিত হলে নিশ্চয়ই ভালো সুপারিশ আসবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

আদেশে বলা হয়, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বিতরণ ও আদায় পদ্ধতির দুর্বলতা খুঁজতে এই কমিটিতে দক্ষ ব্যাংকাররা থাকবেন। সাবেক ব্যাংকার ও প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের কমিটিতে যুক্ত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কমিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া, সেবার মান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জবাবদিহি খতিয়ে দেখবে। ব্যাংকিংয়ের ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতামত ও পরামর্শ দেবে কমিটি। কমিটির সুপারিশ অনুসরণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতে এত লুটপাট হচ্ছে, কারও শাস্তি হচ্ছে না। এরপরও কমিটি গঠনের উদ্যোগে স্বস্তি পেলাম। কমিটি গঠিত হলে নিশ্চয়ই ভালো সুপারিশ আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এরপরও আমি আশাবাদী।’

রিটকারী সংগঠন এইচআরপিবির আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘মেরুদণ্ডহীন কাউকে দিয়ে এই কমিটি করা হলে কাজে আসবে না, শুধু সময়ক্ষেপণ হবে। এদিকে অর্থ তছরুপ চলতেই থাকবে। অর্থ তছরুপ বন্ধে সব পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি জড়িত ব্যক্তিরা বিচারের আওতায় আসুক। এতে আমানতকারীরা স্বস্তি পাবেন।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ১১ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ গুণের বেশি।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা নয়। বেনামি ঋণ, এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা এখন প্রধান সমস্যা। এসব দূর করতে পারলে ব্যাংক খাত ঠিক হয়ে আসবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনীতিক সদিচ্ছা।

এদিকে ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। সেই প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের মালিক ও ঋণখেলাপিদের সহায়ক শক্তির ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে সরকারকে।