শেয়ার কিনে ব্যাংকের মালিকানা দখল ও ফাইলবন্দী একটি রিপোর্ট

দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একসময় ব্যাংক সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এই কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক সচিব কাজী ফজলুর রহমান। ১৯৯৭ সালে কমিটি পুনর্গঠন করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে।

তারপর ২০ বছর চলে গেছে। ব্যাংক খাত আরও বড় হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতের তদারকির অভাব প্রকট হয়েছে। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাতকে অনায়াসে নাজুক বলা যায়। নাজুক ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই নতুন করে একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি বহুদিনের।

এমনকি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

কিন্তু সেই কমিশন গঠন আর হয়নি। মাঝে অবশ্য একবার গুঞ্জন ছিল যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করেই কমিশন গঠন করা হবে। এ নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। হয়তো একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের সাহস দেখানো সম্ভব হয়নি।

সেই ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আজ বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাংক খাত ও কমিটির রিপোর্ট নিয়ে কিছু কথা লিখেছেন। সেখানে ১৯৯৯ সালের রিপোর্টটির একটি ছবি সংযুক্ত করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত আমার এক প্রাক্তন ছাত্র এই ছবিটি তুলে আমাকে পাঠিয়ে বলেছে রিপোর্টটি ব্যাংকের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে এবং সে এটি পড়ে খুব উপকৃত হয়েছে, কারণ, তার মতে ব্যাংক খাত সংস্কারের সব নির্দেশনাই এতে আছে।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অবশ্য ব্যাংক সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন নিয়ে খানিকটা হতাশার কথাই লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, এই রিপোর্টের বেশ কিছু সুপারিশ একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রবিধি হিসাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং আইনে রূপান্তরিত করা হয়নি বলে সেগুলো আর কার্যকর থাকেনি। বরং ব্যাংকিং আইনে বিধিনিষেধগুলো আরও শিথিল করার ফলে অনিয়মের সুযোগ আরও বেড়ে গেছে। এ নিয়ে তিনি আরও লিখলেন, ‘তার চেয়ে বড় কথা হলো, এত আয়োজন ও পরিশ্রম করে তৈরি সংস্কারের রিপোর্ট তো লাইব্রেরিতে শেলফবন্দী হয়ে থেকে লাভ নেই যদি বাস্তবায়ন না হয়।’

প্রায় তিন বছর ধরে সংস্কার কমিটি কাজ করেছিল। সেই কাজের অভিজ্ঞতা কী রকম? অন্তত একটি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি লিখেছেন, ‘মনে আছে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এই সংস্কার কমিটির কাজ শুরু করার সময় ব্যাংকমালিকদের সংগঠনের মিটিংয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা তো ব্যক্তি খাতে ব্যাংকিং ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন মুনাফা পেতে, ব্যাংক ভালো চললে তো আপনাদেরই লাভ। উত্তরে সংগঠনের সভাপতি যা বললেন, তার সারাংশ দাঁড়ায়: বোকার ভান করবেন না, মূলধন ছাড়াও অনেক বাড়তি খরচ করে ব্যাংক দিয়েছি; এখন নিজেদের জন্য সেই ব্যাংকের আমানতের অন্তত কিছু অংশ নিয়ে নেব না, তা কি হয়?’ এরপর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, ‘সে সময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের তিন ভাগের এক ভাগই ছিল উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নেওয়া ঋণ, যার অধিকাংশই ছিল খেলাপি।’

উত্তরে সংগঠনের সভাপতি যা বললেন, তার সারাংশ দাঁড়ায়: বোকার ভান করবেন না, মূলধন ছাড়াও অনেক বাড়তি খরচ করে ব্যাংক দিয়েছি; এখন নিজেদের জন্য সেই ব্যাংকের আমানতের অন্তত কিছু অংশ নিয়ে নেব না, তা কি হয়?’

রিপোর্ট দেওয়ার পরে অবশ্য ব্যাংক খাতে একটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, ‘পরবর্তী সময়ে ব্যাংক সংস্কারের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ ও উচ্চ আদালতের সক্রিয়তার কারণে অন্তত ৫৪ জন উদ্যোক্তা-পরিচালককে অপসারণ করা হয় নিজেদের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে। এ ছাড়া আরও ৭৩ জন তাঁদের নেওয়া ঋণ নিয়মিত করতে বাধ্য হন। আর ৮ জন তখন আদালতের স্থগিতাদেশ নিতে সক্ষম হন। এরপর থেকে উদ্যোক্তা–পরিচালকদের এ ধরনের ঋণ নেওয়ার সংস্কৃতির অবসান হয়; দেখা গেল, আইনত যে পরিমাণ ঋণ তাঁরা নিতে পারেন, তা–ও নিচ্ছেন না।’

এখানে অবশ্য একটা কথা থেকে যায়। পরিস্থিতি আর সে রকম নেই। উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা এখন নিজেদের ব্যাংক থেকেও ঋণ নেন, অন্য ব্যাংক থেকেও নেন। নিজের ব্যাংক থেকে নেন বেনামে, আর অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন পারস্পরিক যোগসাজশে, বিনিময় প্রথার মতো করে। এর ভালো একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার আবদুল্লাহ আল কাফি। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের লেখার নিচে তাঁর মন্তব্যটা ছিল এ রকম,‘একজন সাবেক ব্যাংকার হিসেবে বলছি, নিজের ব্যাংক থেকে নেওয়াটা বন্ধ হলেও তুমি আমার ব্যাংক থেকে নাও, আমাকে তোমার ব্যাংক থেকে দাও সংস্কৃতি চালু হয়েছিল।’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০ বছর পরে ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে কী ভাবছেন ব্যাংক সংস্কার কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান। এ নিয়েও লিখেছেন তিনি। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, ‘তবে আমার মতে এই রিপোর্টের কিছু বিষয় যুগোপযোগী করা দরকার। যেমন বাজার অর্থনীতিতে শেয়ার কিনে একটি ব্যাংকের মালিকানা দখল করার সুযোগ থাকে, কিন্তু এ সুযোগের অপব্যবহার করে এ খাতে একচেটিয়া দখলদারি তৈরি হওয়া যে বিপজ্জনক এবং তার প্রতিকারের কিছু নিয়মনীতি থাকা যে দরকার, তা এই রিপোর্টে নেই। অলাভজনক খেলাপি প্রতিষ্ঠান বন্ধের জন্য দেউলিয়া আইনের সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারেও তেমনটা বলা হয়নি।’

১৯৯৯ সালে হয়তো কল্পনা করা যায়নি যে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনেও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া যায়। এই প্রবণতা বাংলাদেশে দেখা গেছে গত দশকে। আর এ ক্ষেত্রে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে সহায়তা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
২০ বছর আগে ব্যাংকমালিকদের হাত থেকে ব্যবস্থাপনাকে রক্ষা করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই পক্ষের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হতো। ব্যাংক সংস্কার কমিটি বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করেছিল বলেই টেলিফোন আলাপে জানালেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এখন অবশ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে রক্ষার বিষয়টি আর নেই। এখন অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে যোগসাজশ, তারা এখন মালিকদের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সহযোগী। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্ত তদারকি জরুরি।

রিপোর্টের কিছু বিষয় যুগোপযোগী করার দরকারের তালিকায় আরেকটি নতুন বিষয় হচ্ছে অর্থের যেকোনো ধরনের অপব্যবহার বা মানি লন্ডারিং, যা নব্বইয়ের দশকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এখন বরং অর্থ পাচার বা দুর্নীতির অর্থ–তথ্য বের করা সহজ। ব্যাংকের কোন হিসাব থেকে কোন হিসাবে গেছে, এখন তা সহজেই বের করা যায়। কিন্তু কাজটি করা হয় না।

এ কারণেই হয়তো ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সবশেষে লিখেছেন, ‘ইদানীং ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি শিথিল করার ফলে আরও মারাত্মক ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, একসময় কিছু দূর অগ্রসর হয়ে আমরা যেন আবার পেছনের দিকে হাঁটছি।’

আরও পড়ুন