শ্রমিক–সংকটে গতি হারিয়েছে চামড়া প্রক্রিয়ার কাজ

সাভার চামড়াশিল্প নগরের আনোয়ার ট্যানারিতে দেড় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। ঈদুল আজহার সময় শ্রমিকের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু চামড়ার চূড়ান্ত সময়ে আনোয়ার ট্যানারিতে এখন শ্রমিক আছেন মাত্র ৩০ জন।

ঈদুল আজহার ছুটিতে যাঁরা বাড়ি গেছেন, কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তাঁরা কারখানায় ফিরে আসতে পারেননি। এত কম শ্রমিক দিয়ে চামড়া সংগ্রহ, লবণ দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আনোয়ার ট্যানারির মালিককে

শুধু আনোয়ার ট্যানারি নয়, সাভার চামড়াশিল্প নগরে বেশির ভাগ চামড়া কারখানার একই চিত্র। শ্রমিক-সংকটের কারণে চামড়ায় লবণ দেওয়া, সংগ্রহ করা ও ওয়েট ব্লুর (চামড়া প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ) কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে এবার শ্রমিক-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। যাঁরা বাড়ি গেছেন, তাঁরা বিধিনিষেধের কারণে আর ফিরে আসতে পারেননি। যাঁরা এসেছেন, অনেক ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাঁদের।

আনোয়ার ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলজাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক-সংকটের কারণে চামড়ার কাজে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে। ঈদের পর যাঁরা বাড়ি গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই আসতে পারেননি। তা ছাড়া মৌসুমি শ্রমিকও আসতে পারেননি। তিনি বলেন, চামড়ার মতো কাঁচামাল বেশি দিন রাখা যায় না। লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। কিন্তু এত অল্প শ্রমিক দিয়ে বিশাল কাজ করতে হচ্ছে।

জানা গেছে, ঈদুল আজহার ছুটিতে ঢাকা ছেড়েছিলেন ১ কোটি ৫ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী। তাঁদের মধ্যে ৮ লাখের কিছু বেশি গ্রাহক ঈদের পরদিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরেছেন। ৯২ লাখের মতো মানুষ ঢাকায় ফেরেননি অথবা ফিরতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উপায়ে অনেকে ঢাকায় ফিরেছেন, যদিও বড় একটি অংশ এখনো বাড়িতে রয়ে গেছে।

এদিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ঈদের পর ২৩ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ চলছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ে কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কঠোর বিধিনিষেধের আওতার বাইরে থাকার কথা জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপরও শ্রমিক মিলছে না চামড়াশিল্প নগরে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় সাভার চামড়াশিল্প নগরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক প্রয়োজন হয়। কিন্তু এবার প্রয়োজনের তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা বেশ কম। এর মূল কারণ কঠোর বিধিনিষেধ। যদিও সাভার চামড়াশিল্প নগরে অবস্থিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনেকে এখনো ঢাকা থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে যাতায়াত করেন। চামড়াশিল্প নগরে তাঁদের আবাসনের কথা বলা হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। সেখানে স্বাস্থ্যসুবিধা নেই।

চুক্তিভিত্তিক কাজ করা শ্রমিক আমীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাজারীবাগ থেকে প্রতিদিন সকালে পিকআপে করে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আবার রাতে হাজারীবাগে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই জীবন চলছে।

শ্রমিকদের কেউ থাকেন চামড়াশিল্প কারখানার পাশে হরিণধরা ইউনিয়নে। মোহাম্মদ নুরুন্নবী নামের একজন শ্রমিক জানান, হরিণধরা ইউনিয়নে ছয় হাজার টাকা ভাড়ায় পরিবার নিয়ে থাকেন। কিন্তু যে টাকা মজুরি পান, সেই টাকায় সংসার চলে না। শাকিল নামের এক ঠেলাগাড়িশ্রমিক জানান, ৪০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। এই দীর্ঘ সময়ে নিজের উন্নতি হয়নি। চামড়াশিল্প নগরের শ্রমিকদের জন্য আবাসন, বিনোদন ও তাঁদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক করার কথা থাকলেও এসব সুবিধা এখনো অধরা।

যখন হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প নগরী সাভারে স্থানান্তরিত হয়, তখন থেকেই শ্রমিক কমতে থাকে। দূরত্বের কারণে তখন অনেক শ্রমিক সেখানে যায়নি। আবার এই পেশায় নতুন করেও আশানুরূপ শ্রমিক আসছেন না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানায় শ্রমিক-সংকট আছে। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে শ্রমিক আসতে পারছেন না। আসার জন্য অনেকে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু ভয়ে আসতে পারছেন না। আবার কিছু শ্রমিক চামড়ায় লবণ লাগাতে চট্টগ্রামে গেছেন। তাঁরাও ফিরে আসেননি। তবে আগামী সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’