সংকটের এই সময় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ উচ্চাভিলাষী

গতকাল সোমবার সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি কর্তৃক আয়োজিত ‘বাজেট–পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠান-২০২০’–এ বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত
গতকাল সোমবার সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি কর্তৃক আয়োজিত ‘বাজেট–পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠান-২০২০’–এ বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান এই সংকটের সময় প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ উচ্চাভিলাষী। এবারের এই ৬ শতাংশ ঘাটতি বাজেটের প্রেক্ষাপটে এমন উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ লাভের ক্ষেত্রে একটি ভুল বার্তা দেবে বলেও মনে করা যায়। গতকাল সোমবার সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি কর্তৃক আয়োজিত ‘বাজেট–পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠান-২০২০’–এ বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আয়োজিত হয়।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক এম আবু ইউসুফ। তাঁর প্রবন্ধেই তিনি লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী বলে অভিমত দেন। তিনি অবশ্য সরকারকে অভিনন্দন জানান এই মহামারি সংকটের মাঝেও সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট ঘোষণা করার জন্য। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংকট পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাজেটে এমন কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়টি জড়িত। তেমনি করোনা সংকটের কারণে উদ্ভূত এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যার প্রতি সরকারের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। বাজেটে ৬ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য কর প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। এ জন্য কর গ্রহণে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর আহ্বান জানান তিনি। এই সংকটের সময়ে শিক্ষার গুরুত্ব এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে শিক্ষায় আরও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য খাতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাজেট সামান্য বৃদ্ধি পেলেও তা কোভিড-১৯–এর মতো মহামারি মোকাবিলায় কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ওপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। আলোচনায় অতিথি ছিলেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধীরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম। আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক তৈয়্যবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমরান হোসেন ভূঁইয়া।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। তিনি উল্লেখ করেন, নীতিনির্ধারকেরা যদি সব মহলের সঙ্গে, বিশেষ করে নাগরিক সমাজ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একটি কার্যকর যোগাযোগ বা সমন্বিত মতামতের ভিত্তিতে বাজেটসহ অন্য সব রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারেন, তাহলেই কেবল কোভিড-১৯–এর মতন অন্যান্য বৃহৎ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।

মূল প্রবন্ধের ওপর বিশেষ প্রথম আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক সেলিম রায়হান। এবারের বাজেটকে তিনি গতানুগতিক বাজেট বলে মনে করেন, তবে সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং কৃষি খাতে বরাদ্দ সংশোধনের পাশাপাশি মৌলিক কিছু দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আশা করেন তিনি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা—এই তিন খাতে গত কয়েক দশকের জিডিপি বৃদ্ধির বিবেচনায় বাজেটের তেমন বৃদ্ধি হয়নি। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে দাম বাড়ছে, তা খাদ্য নিরাপত্তাকে সামনের দিনগুলোয় হুমকির মুখে ফেলতে পারে।’

অধ্যাপক তৈয়্যবুর রহমান বাজেটে সংসদীয় কমিটির ভূমিকা আরও বাড়ানো বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। সাংসদদের বাজেট বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়া পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটিকে আরও কার্যকর করা এবং বাজেট বাস্তবায়নে এ রকম প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অধ্যাপক রুমানা হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট যতটুকু বাড়ানো হয়েছে, তবে তা অপ্রতুল আমরা সবাই জানি। কিন্তু কতটা অপ্রতুল, সে বিষয়ে গবেষণা বা চিন্তা খুব একটা নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্য খাতে চাহিদাভিত্তিক বরাদ্দ বৃদ্ধিতে আমাদের বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। কারণ, এখনো মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ যে খুব বেশি বাড়েনি, তা সহজেই বোঝা যায়। তাই এ খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হলে এখানে যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন, সেখানে শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ার বিষয়টি এই খাতের সমন্বয়হীনতাই প্রকাশ করে।’ সবশেষে তিনি, বর্তমান সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত ১০০ কোটি টাকাসহ পুরো স্বাস্থ্য বাজেটের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘বর্তমান কোভিড-১৯ সংকট আমাদের এই শিক্ষা দেয়, আমাদের রাজধানীকেন্দ্রিক চিন্তাধারা বদলে গ্রামীণ, উপজেলা ও জেলাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা আরও শক্তিশালী করতে হবে।’ তিনি এবারের বাজেটে কাজ হারানো নারী শ্রমিক এবং বিদেশফেরতদের জন্য প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার আহ্বান জানান।

সম্মাননীয় অতিথির বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে আমরা আজকে খাদ্য নিরাপত্তায় যেমন সুফল পেয়েছি, স্বাস্থ্য বা শিক্ষা গবেষণায় কিন্তু তেমন কোনো বরাদ্দ আমরা কখনো করিনি।’ কৃষি গবেষণার মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত সেবা নিশ্চিত করবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময় বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি বর্তমান এই সংকটময় মুহূর্তে স্কুল স্টাইপেন্ড এবং স্কুল মিল প্রোগ্রামগুলোর আওতা ও পরিমাণ বাড়াতে হবে বলেও মতামত দেন তিনি। এ ক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পগুলোর ওপর কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও শিক্ষার মতো খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে যাওয়া বা শিক্ষা খাতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য মৌলিক কিছু দিকনির্দেশনাও আমাদের বাজেটে থাকা দরকার। আমাদের শিক্ষার মান, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়াতে হলে প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এই বহুমুখী সংকটের সময়ে আমাদের সামষ্টিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে প্রান্তিক মানুষ ও শ্রমিকদের যেন আমরা কাজে নিযুক্ত রাখতে পারি এবং তাদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে পারি, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এবারের বাজেটটিকে বেঁচে থাকার বাজেট হিসেবে উল্লেখ করে সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন তিনি লক্ষ করেছেন বলে জানান। তিনি সরকারের সীমাবদ্ধতার কথা খেয়াল রেখেই কিছু খাতে সাশ্রয়ী হয়ে বা কিছু মেগা প্রকল্পের বাজেট কমিয়ে এনে আমাদের অগ্রাধিকার খাত যেগুলো আছে (যেমন স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা এবং শিক্ষা), সেখানে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে বলে মতামত প্রকাশ করেন।