ফিরে দেখা ২০২১
সমৃদ্ধির স্বীকৃতি পাওয়ার বছর
গত ফেব্রুয়ারি মাসে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। তবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ছয় বছর আগে থেকেই প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। ২০১৫ সালে প্রথম এই প্রত্যাশার পারদ ওপরে উঠতে শুরু করে। কিন্তু সে বছর তিনটি সূচকের মধ্যে একটিতে মান অর্জন করে বাংলাদেশ। অর্থাৎ আশায় গুড়ে বালি।
তিন বছর পর ২০১৮ সালে জাতিসংঘের পরবর্তী মূল্যায়নে তিনটি সূচকের সব কটিতেই মান অর্জন করে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। এরপর আরও তিন বছর কেটে যায়। অবশেষে চলতি ২০২১ সালের শুরুর দিকে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। তারা ঠিক করে দেয়, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
শুধু তা–ই নয়, গত নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশ সম্পর্কে সিডিপির সুপারিশ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়টি কারিগরি পর্যায় থেকে রাজনৈতিক টেবিলে চলে গেল অনুমোদনের জন্য। বাংলাদেশ প্রস্তুতির জন্য পেল পাঁচ বছর। কারণ, এলডিসি থেকে বের হলে অনেক বাণিজ্য সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতি হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার আরেক ধাপ উত্তরণ। আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে ২০২১ সালেই অন্যতম বড় স্বীকৃতি মিলল। এটি সমৃদ্ধির স্বীকৃতি।
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান কোথায় বা এই মুহূর্তে কোন কোন দেশের কাতারে আছে, তা দেখা যাক। সোজা কথায়, উগান্ডা, কিরিবাতি, হাইতি, টুভালু, জিবুতি, গিনির মতো দেশের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে ২০২৬ সালে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ।
নজিরবিহীন মান অর্জন
বাংলাদেশই একমাত্র এলডিসি, যারা তিনটি সূচকেই মান অর্জন করেছে। এটি নজিরবিহীন। সূচকগুলো হচ্ছে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক। এর আগে কোনো দেশ সব কটি সূচকে মান অর্জন করে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ পায়নি। ২০১৮ ও ২০২১ সাল দুবারের মূল্যায়নেই তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
২০২১ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশ ২৭ দশমিক ২ পয়েন্ট পেয়েছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে এ সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। বাংলাদেশের আছে ৭৫ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২২২ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। এবারের মূল্যায়নে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮২৭ ডলার। মাথাপিছু আয় হিসাবটি জাতিসংঘ করেছে এটলাস পদ্ধতিতে। সেখানে মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে তিন বছরের গড় হিসাব করা হয়।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে রপ্তানি
২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আওতায় বিশেষ শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা কমতে শুরু করবে।
স্থানীয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি আয় কমবে, যা বর্তমান বাজারদরে স্থানীয় মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অবশ্য ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থাকবে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে কী হবে? উত্তর সহজ, এলডিসি হিসেবে এখন বাংলাদেশের কোনো পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর তখন নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। অন্যদিকে উন্নয়ন সংস্থা ও দেশগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে।
৫০ বছরে ছয় দেশ
উন্নয়নশীল ও উন্নত—এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বেশি পিছিয়ে থাকা দেশগুলো নিয়ে ১৯৭১ সালে এলডিসি তালিকা করা হয়। বর্তমানে ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ আছে। এই পর্যন্ত মালদ্বীপসহ মোট ছয়টি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে।