সাভার চামড়াশিল্প নগরী: এক প্রকল্প শেষ করতেই ১৮ বছর

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
>খরচ বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ
খরচ ১৭৫ কোটি থেকে বেড়ে ১০১৫ কোটি টাকা
গত ১৭ বছরে ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে খরচ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা

সাভারে চামড়াশিল্প নগরীর প্রকল্পটি যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এরপর ১৭ বছর অতিবাহিত হলেও প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। একটি প্রকল্পে যত ধরনের সমস্যা দেখা যায়, সব সমস্যাই এখানে হয়েছে। যেমন, খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধি, প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দুর্বলতা ইত্যাদি। 

প্রকল্পটির মেয়াদ এরই মধ্যে সাতবার বাড়ানো হয়েছে। খরচ বাড়ানো হয়েছে তিনবার। তাতে তিন বছরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১৭ বছরেও তা শেষ হয়নি। ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পের খরচ এখন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সবচেয়ে পুরোনো প্রকল্প এটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)।

এমন অবস্থায় প্রকল্পটি চতুর্থবারের মতো সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্ধিত এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হলে তাতে এক প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে ১৭ বছর বা প্রায় ১৮ বছর সময় লাগছে। নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো হলেও খরচ কিছুটা কমিয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে। আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উঠবে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। 

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্প অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখাতে এ প্রকল্পটি পাঠ্যপুস্তককে নমুনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একটি প্রকল্প গত ১৭ বছরেও শেষ না করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের অদক্ষতা ও অনীহার জন্য শুধু শিল্প মন্ত্রণালয় নয়; অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না।’ 

পুরান ঢাকার হাজারীবাগ ও দেশের অন্য স্থানের ট্যানারি কারখানাগুলোকে সাভারে স্থানান্তরের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। পরিবেশদূষণ যাতে না হয়, সে জন্য সাভারে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যেমন এসটিপি, সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ডসহ যাবতীয় আধুনিক সুবিধা নির্মাণ করাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। গত ১৭ বছরে প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। খরচ হয়েছে ৭৯২ কোটি টাকা। গত জুন মাসেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, প্রশাসনিক ভবন, সড়কবাতি, প্রধান গেটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। 

প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫৫টি চামড়া শিল্পকারখানা স্থানান্তর করা হয়েছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে চামড়াশিল্প থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। 

জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সিইটিপির কাজ শেষ। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। একটি চীনা ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। ওই ঠিকাদার টালবাহানা করায় সময়মতো কাজ শেষ হয়নি।

বারবার সংশোধন
এই প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ১৭৫ কোটি টাকা এবং মেয়াদ ২০০৩ থেকে জানুয়ারি থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। পরে ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭, ২০১০, ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। আর খরচ বৃদ্ধি করা হয় ২০০৭, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো প্রথমে এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ছিল না, পরে তা সংযোজন করা হয়। এ ছাড়া সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করায় এর খরচ ও মেয়াদ বেড়েছে। অন্যদিকে হাজারীবাগের ট্যানারির মালিকদের সাভারে স্থানান্তর নিয়েও অনীহা ছিল। এসব কারণেই প্রকল্পের কাজ বারবার পিছিয়ে গেছে। 

প্রকল্পের দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ১৭ বছরে ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে বেতন–ভাতা ও বাড়িভাড়ায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া উৎসব ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা, ধোলাই ভাতা, যাতায়াত, ওভারটাইম, পোশাক ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে আরও দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছে।