সাহসী লক্ষ্য, নড়বড়ে ভিত

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবারের বাজেটে ‘কালো মেঘের আড়ালে সোনালি রেখা’ দেখতে পান৷ গতানুগতিকতা মেনে নিয়ে প্রস্তাবিত এ বাজেটের আকার যেমন বেড়েছে, বেড়েছে বাজেট বক্তৃতার পৃষ্ঠা সংখ্যা, তেমনি বেড়েছে অর্থমন্ত্রীর উচ্চাভিলাসও।
তবে কর্মব্যস্ত আশি বছর অতিক্রম করা অর্থমন্ত্রী যতই সোনালী রেখা দেখতে পান, স্বপ্ন দেখানোর ভিত্তিটা যথেষ্ট মজবুত নয়। ছয় বছর ধরে তিনি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন, বিনিয়োগ বাড়েনি। তিন অর্থবছর ধরে তিনি ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের গল্প বলছেন৷ কিন্তু প্রবৃদ্ধি সেই ৬ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। বরং এবার নতুন করে এক দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে অর্থমন্ত্রীর প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনায়। প্রবাসী-আয়ে গত ১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
খানিকটা নড়বড়ে ভিতের আরও কিছু তথ্য অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতেই আছে। যেমন, বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা মেনে তিনি আয় করতে পারেননি, ব্যয়ও করতে পারছেন না। সীমার মধ্যে থাকলেও বাজেট ঘাটতি বেড়েছে। এমনকি বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কত হলো এর হিসাবও মেলেনি।
তারপরও উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সাহস দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দুর্বলতাগুলোর কথাও বলেছেন। অর্জন যাই থাকুক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই

মধ্যআয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য আরও কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এম এ মুহিতের সবচেয়ে সাহসী পরিকল্পনা রাজস্ব আদায়ের নতুন হিসাব। বিশেষ করে আয়করকে সবার উপরে রাখার কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রচণ্ড সাহস দেখিয়েছেন তিনি। আর এই সাহসটিই বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল আর ঝঁুকিপূর্ণ দিক।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের যে বাজেটটি পেশ করেছেন, সেটি বড় ব্যয় ও বড় আয়ের বাজেট। এই বড় আয় নির্ভর করছে মূলত আয়কর আদায়ের ওপর, আর বড় ব্যয় নির্ভর করছে পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর। এই আয়-ব্যয় পরিকল্পনার মধ্যে কতখানি ভারসাম্য রাখতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে অর্থমন্ত্রীর বাজেটের উচ্চাভিলাস। বলা যায় নতুন বাজেট হচ্ছে দুর্বল একটি রাজস্ব কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো অতি উচ্চাভিলাসী প্রয়াস।
নতুন বাজেটটি আরও কিছু দিক থেকে ব্যতিক্রম। এটি নতুন করে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রথম বাজেট। শেষ কবে বিরোধী দলের উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট দিতে পেরেছিলেন, সেটি এখন গবেষণার বিষয়। তবে এবার তা পেরেছেন, যদিও এবারের বিরোধী দল সরকারেরই অংশ। তাই অর্থমন্ত্রী হাততালি ও টেবিল চাপড়ানো পেয়েছেনও বেশি। বাজেট বক্তৃতা শুরু হয় বেলা তিনটা ৪০-এর দিকে।
এর আগে গতকাল বেলা একটার দিকে অর্থবিল অনুমোদনের জন্য সংসদের ক্যাবিনেট কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ অন্য মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেল তিনটার দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অর্থবিল অনুমোদন করে। এরপর সোয়া তিনটার দিকে বিলটি অনুমোদন করে তাতে সই করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং বিল আকারে সংসদে উত্থাপনের জন্য তা সংসদ সচিবালয়ে পাঠান।
গতকাল বিল উত্থাপনের সময় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও এইচ এম এরশাদসহ জাতীয় পার্টির অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, এর আগে নবম সংসদের কোনো বাজেট অধিবেশনে অর্থবিল উত্থাপনের সময় বিরোধী দল বিএনপি সংসদে উপস্থিত ছিল না। তবে অষ্টম সংসদে শুরুর দিকে অর্থবিল উত্থাপনের সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদে উপস্থিত ছিল।
বাজেট পরিসংখ্যান: নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ।
অন্যদিকে বাজেটের মোট আকারের মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে সরকারের আয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। এই আয় জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট আয় ধরা ছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। তবে তা সংশোধন করে ঠিক করা হয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ ৬২৭ কোটি টাকা।
সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে আসবে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৮ শতাংশ, আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রীর ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনাটিও যথেষ্ট উচ্চাভিলাসী। কারণ, ২৪ হাজার কোটি টাকা বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার কোনো রেকর্ড বাংলাদেশের নেই। সুতরাং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ না পেলে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা কম ঋণ পাবেন৷ আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে নতুন করে অর্থ ছাপাতে হবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। যদিও অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশেরও কম মূল্যস্ফীতির স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন: প্রতি বাজেটের আগে প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে বিতর্ক একটি রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দেখা গেছে, গত চার অর্থবছর ধরেই অর্থমন্ত্রী ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলে আসছেন। কারণ, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রয়োজন ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন। আর এ কারণে বাস্তবতা যাই থাকুক, লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের নিচে তিনি নামাতে আগ্রহী হননি।
২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ, অর্জন ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ; ১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জন ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ১৩-১৪ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ, কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্জন ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। যদিও এই অর্জন নিয়েও আছে সংশয়। এ কারণেই হয়তো গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী তাঁর পরিকল্পনাকে ‘অশোভনীয় আশাবাদ’ বলেছিলেন।
তবে এবারের বাজেট বক্তৃতার শেষ অংশে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অবশ্যি বলতে পারেন, আমাদের কার্যক্রম এবং অর্থায়ন পরিকল্পনা উচ্চাভিলাসী। কিন্তু প্রমাণ করেছি যে উচ্চাভিলাসী কার্যক্রম আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি।’
রাজস্ব কার্যক্রম: ভারতের নতুন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বহুগুণ বাড়ানোর পক্ষে। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, এতে মধ্যবিত্তরা বেশি অর্থ

সাশ্রয় করতে পারবে এবং এই অর্থ তারা অন্য খাতে ব্যয় করবে। তাতে অর্থনীতি আরও সচল হবে। নির্বাচনের পরেও ভারতের মধ্যবিত্ত ভোটাররা এতে খুশি হয়েছেন। কিন্তু সে পথে হাঁটলেন না আমাদের অর্থমন্ত্রী। সাধারণ মানুষদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ালেন না তিনি। তবে বড় লোকদের ওপর বেশি হারে আয়কর ও বেশি সম্পদের ওপর সারচার্জ বসিয়েছেন তিনি। যদিও দেশের ধনীগোষ্ঠী বেশি আয়কর দেন এমন উদাহরণ এখনো দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজস্ব কর্মকর্তারা ধনীদের দিকে কতদূর পর্যন্ত আগ্রাসী হতে পারবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে অর্থমন্ত্রীর রাজস্ব পরিকল্পনার সাফল্য।
স্থানীয় শিল্পকে অনেকটাই কর ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আবার সম্পূরক শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর কারণে আমদানি পণ্যেরও দাম কমবে। বাড়িওয়ালারা নিশ্চই এরই মধ্যে কপালে ভাঁজ ফেলেছেন৷ কারণ, ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে নিতে হবে। যাঁরা নতুন ফ্ল্যাট বা জমি কিনবেন, তাঁদেরও এখন আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে। বিড়ি-সিগারেটের ওপর কর বাড়িয়ে প্রকৃতপক্ষেই ধূমপায়ীদের উপকার করলেন অর্থমন্ত্রী। আর এতে রাজস্ব বোর্ডেরও লাভ হবে, তারা বেশি রাজস্ব পাবে। সম্পূরক শুল্ক কমানোর কারণে কিছু গাড়ির দামও কমবে।
অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘অগ্রগতির ধারাবাহিকতা: সম্ভাবনাময় আগামীর পথে বাংলাদেশ।’ আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে সরকারের ঘোষিত পথনকশার নাম ‘রূপকল্প-২০২১’। আর প্রতিশ্রুতি হচ্ছে এই সময়ের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। অর্থমন্ত্রী এই কথাটিই আমার মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হবে উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি আর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি।
এ জন্য অর্থমন্ত্রী দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা শেষ করেছেন। বাজেট বাস্তবায়নের বড় ঝঁুকি এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাই। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রীর ‘ধারণা’ বিশ্ব অর্থনীতিও তাঁর জন্য সহায়ক হবে, বাড়বে বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাড়বে প্রবাসী-আয়, কমবে বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য। একই সঙ্গে দেশের মধ্যেও আদায় বাড়বে রাজস্বের, গত ছয় বছরে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি না করতে পারলেও বাড়বে বেশি বিনিয়োগ, তৈরি হবে কর্মসংস্থান, পোশাক, তথ্য প্রযুক্তি ও জাহাজ শিল্প রপ্তানি আয়কে বাড়াবে বহুগুণ।
সব মিলিয়ে অনেকগুলো আশাবাদ ও ধারণার ওপর নির্ভর করেই পুরো একটি অর্থবছর বাজেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। কেননা, শুরুতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই পরিণত বয়সেও দ্বিতীয়বারের মতো অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। তিনি বলেছেন, ‘আমার ওপর তাঁর এই অকুণ্ঠ আস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমি এ গুরুদায়িত্ব পালনে আমার সকল প্রয়াস নিয়োজিত রাখব।’
আবারও প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন
আগের তিন অর্থবছরেও ৭% প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু অর্জন ৬%–এর কিছু বেশি। আবার ৭.৩% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী
মধ্যবিত্তের হতাশা
প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল মধ্যবিত্তকে স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়বে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশই হতে হলো
কালোটাকা আছেই
আগেই আয়কর আইনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া ছিল, বাজেটে এ নিয়ে একটি কথা না বলেও সুযোগটি বহাল রাখা হলো৷
অর্থমন্ত্রীর কপালে ভাঁজ
ব্যক্তি বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটেনি ছয় বছরেও, নতুন করে শঙ্কা জাগিয়েছে প্রবাসী-আয়। ১০ বছরের মধ্যে প্রথম ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি প্রবাসী-আয়ে